“কিছু ত্রুটি চোখে পড়েছে৷ তা সমাধান করা হবে। আমরা মনে করছি, এবার শুরু থেকেই মেলা পুরোদমে চালু হয়েছে,” বলেন বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব সরকার আমিন।
Published : 02 Feb 2025, 11:21 PM
জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এবার শুরু থেকেই জমে উঠেছে অমর একুশে বইমেলা, যেখানে সব মতাদর্শের মানুষের সম্মিলন প্রত্যাশা করছেন বইপ্রেমীরা।
প্রথম দিন বিকালে বইমেলার দুয়ার খোলার পর থেকেই দেখা গেছে লোক সমাগম, আর দ্বিতীয় দিনে মিলনমেলায় পরিণত হয় বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চত্বর।
প্রথম দিন থেকে স্টলগুলোতে বই বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে, তবে দ্বিতীয় দিনও কয়েকটি স্টলে দেখা গেল নির্মাণ কাজ চলছে। অব্যবস্থাপনার অল্প-বিস্তর অভিযোগ সমাধানের চেষ্টার কথা বলেছে মেলা কমিটি।
রোববার ছিল অমর একুশে বইমেলার দ্বিতীয় দিন। মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বইমেলা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তত ৯০ শতাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের স্টলের নির্মাণ সম্পন্ন করে পুরোদমে বই সাজিয়ে বসেছেন।
মেলা পরিচালনা কমিটির ভাষ্য, ১০ শতাংশ স্টলের নির্মাণ শেষ হয়নি। তবে চতুর্থ দিন থেকে মেলার মাঠে আর কোনো নির্মাণ কাজ থাকবে না বলে আশা কমিটির।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য-সচিব সরকার আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ আমরা একটি দল বিকালেই মেলার মাঠ ঘুরে দেখেছি। কিছু ত্রুটি চোখে পড়েছে৷ তা সমাধান করা হবে। আমরা মনে করছি, এবার শুরু থেকেই মেলা পুরোদমে চালু হয়েছে।”
“মেলার প্রবেশ গেইটে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা যেন আরো তৎপর হয়ে নিরাপত্তার কাজটি করেন, তার ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি।”
এদিন বিকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এসেছিলেন জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এক সময় বইমেলায় আসার জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছর কেন জানি আমাদেরকে এই স্থান থেকে বঞ্চিত করে রাখা হতো।”
বইমেলা হোক অসংখ্য মানুষের চিন্তা-চেতনা ও দর্শনের সম্মিলন কেন্দ্র হওয়ার আশা ব্যক্ত করে রিজভী বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের, মতাদর্শের লোকও যেন তাদের চিন্তা-চেতনা নিয়ে বই প্রকাশ করতে পারে। নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে পারে। এটা হোক বইমেলা চত্বরের মূল বাণী। কেউ যেন কারো চিন্তা, কারো মত প্রকাশে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।”
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের প্রবল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
দেশের রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের ছয় মাসের মাথায় শুরু হওয়া বইমেলায় এবার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে শতাধিক, বেড়েছে আয়তনও। সেইসঙ্গে মেলার রঙ, প্রতিপাদ্য আর দৃশ্যপটেও এসেছে পরিবর্তন। আর গণআন্দোলনের স্মৃতি স্মরণে রয়েছে ‘জুলাই চত্বর’।
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’- এই প্রতিপাদ্যে আয়োজিত এবারের মেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি স্টল রাখা হয়েছে।
এই স্টলের পাশেই বানানো হয়েছে একটি ডাস্টবিন। সেই ডাস্টবিনে লাগানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন মেট্রোরেলের পিলারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ঘৃণা স্তম্ভে’র ছবি।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ফেইসবুক পেজে এই ডাস্টবিনের ছবি পোস্ট করার পর, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা তৈরি হয়।
রোববারও সেই ডাস্টবিনে এসে ময়লা ফেলে কাউকে কাউকে ছবি তুলতে দেখা যায়। আবার মেলা প্রাঙ্গণে এ ধরণের ডাস্টবিন দিয়ে ঘৃণার চর্চা করা হচ্ছে বলেও অভিমত জানান দর্শনার্থীদের কেউ কেউ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম সাংবাদিকদের বলেন, “মানুষের অভিরুচির স্বতস্ফূর্ত প্রকাশকে তো পদে পদে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তবে এ ব্যাপারটা আমাদের কাছে এসেছে, আমরা এই ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করবো।”
এসেছে নতুন বই
বইমেলার জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, মেলায় রোববার নতুন বই এসেছে ১৩টি। এছাড়াও মেলার মাঠে ঘুরে দেখা গেল, অসংখ্য নতুন বই এসেছে, তবে সেই বইয়ের তথ্য জমা পড়েনি মেলা কমটির তথ্যকেন্দ্রে।
কথা প্রকাশ এনেছে শাহনাজ মুন্নীর ‘প্রিজন ডিল্যাক্স ট্যুর’। আগামী প্রকাশনী এনেছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘চীনদেশে কয়েকবার’, শিমুল সালাহউদ্দিনের ‘কবির মুখোমুখি কবি’, নূরুল ইসলামের ‘গান্ধী-জিন্নাহর রাজনীতি: ভারত-ভাগ’ এবং মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ভূঁইয়ার ‘জয়যাত্রা’।
ঐতিহ্য থেকে এসেছে নয় খণ্ডের পিনাকী ভট্টাচার্য-রচনাবলি, সাব্বির জাদিদের গল্পগ্রন্থ ‘একটি গোলাপের জন্য', আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘শুদ্ধতম কবি’।
আলোচনা-কবিতা পাঠ
এদিন মেলার ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি রাসেল রায়হান, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন শফিক ও শিশুসাহিত্যিক আশিক মুস্তাফা।
মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘হেলাল হাফিজের রাজনৈতিক পাঠ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কুদরত-ই-হুদা। আলোচনায় অংশ নেন মৃদুল মাহবুব। সভাপতিত্ব করেন সুমন রহমান।
কুদরত-ই-হুদা বলেন, “উনসত্তরের গর্ভ থেকে যেসব কবির জন্ম হয়েছিল, কবি হেলাল হাফিজ তাদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতার উচ্চারণ ছিল রাখঢাকহীন, স্পষ্ট, অনাবিল ও অভাবিত।”
“কবিতা তার কাছে কেবল ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাসের বিষয় ছিল না। তিনি মনে করতেন, সমষ্টির জন্যও কবিতার একটা দায় আছে। সত্তর থেকে চুয়াত্তরের মধ্যে যে রাজনৈতিক কবিতাগুলো তিনি লিখেছেন, সেগুলোর মূল সুর কখনো মুক্তিযুদ্ধ, কখনো স্বাধীনতাত্তোর রাজনৈতিক পরিস্থিতিজাত হতাশা, আশাবাদ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের অবস্থা ও অবস্থান, রাষ্ট্রের কাছে কবির প্রত্যাশা, দ্রোহ-এসবই তার কবিতায় কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে।”
মৃদুল মাহবুব বলেন, “কবি হেলাল হাফিজের কবিতার কথা বললেই পাঠকের মানসপটে ভেসে ওঠে-‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ পঙক্তিটি। বাংলা ভাষার যেসব কবি কবিতা, নিজস্ব জীবনদর্শন ও জীবনযাপন দিয়ে মিথ হয়ে উঠতে পেরেছেন, কবি হেলাল হাফিজ তাদের একজন।”
সভাপতির বক্তব্যে সুমন রহমান বলেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঊনসত্তর ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি সময়। কবি হেলাল হাফিজ তার কবিতায় সেই সময়টিকে ধারণ করেছেন। পাশাপাশি, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় উদ্ভূত দ্রোহ, সংগ্রাম, আশাবাদ, বিষাদ সব কিছুই তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন।”
সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় কবিতা পাঠ করেন কবি হাসান হাফিজ ও জাকির আবু জাফর। আবৃত্তি পরিবেশন করেন অনন্যা লাবণী ও শিপন হোসেন মানব।
সুমন মজুমদারের পরিচালনায় ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন সঙ্গীতমঞ্জুরী শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন রিজিয়া পারভীন, প্রিয়াংকা গোপ, ইসরাত জাহান, মিজান মাহমুদ রাজীব, মো. মাইদুল হক ও নাফিজা ইবনাত কবির।
যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন শিমুল বড়ুয়া (তবলা), রাজিব আহমেদ (কি-বোর্ড), মো. মেজবাহ উদ্দিন (অক্টোপ্যাড), সাইদ হাসান ফারুকী (লিড গিটার), পল্লব দাস (বেইজ-গিটার)।
সোমবার যা থাকছে
সোমবার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘হায়দার আকবর খান রনো’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সোহরাব হাসান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন ও জলি তালুকদার। সভাপতিত্ব করবেন দীপা দত্ত।