“তাদের দেশে যে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুলি করে সাধারণ-নিরীহ মানুষগুলিকে হত্যা করা হচ্ছে, এটাতো তাদের দেখা উচিত।”
Published : 02 May 2024, 05:41 PM
মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশসহ অন্যদের ‘সবক’ না দিয়ে আগে নিজ দেশের দিকে নজর দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনের পক্ষের বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগ এবং ‘গণহত্যা’ চালাতে ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র যোগান দেওয়ারও সমালোচনা করেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এসে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সরকারপ্রধান। সেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ আসে।
যুক্তরাষ্ট্রে গুলিতে দুই বাংলাদেশির নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তাদের দেশে যে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুলি করে সাধারণ-নিরীহ মানুষগুলিকে হত্যা করা হচ্ছে, এটাতো তাদের দেখা উচিত। নিজের ঘরকে আগে সামলানো উচিত।”
গুলিতে এবং ছুরিকাঘাতের বিভিন্ন ঘটনায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রাজ্যের বাফেলেতো ভর দুপুরে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদে জানানো হবে কি না, সেই প্রশ্ন রাখা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, “অলরেডি প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আমেরিকায় বসেও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে, সেখানে আমাদের আওয়ামী লীগ খুব সোচ্চার আছে, আমাদের সহযোগী সংগঠন, এটার প্রতিবাদতো আমরা সবসময় করেই যাচ্ছি।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “শুধু প্রবাসী বাঙালি না, আমেরিকায়তো প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করার একটা… ঘরের ভেতরে একটা বাচ্চা ছেলেকে মা ধরে রেখেছে, তাকে গুলি করে মেরে ফেলে দিল। তার অপরাধটা কী ছিল? তার হাতে একটা কাঁচি ছিল। সেই কাঁচির ভয়ে তাকে গুলি করে মারা হল। সেটা সে হয়ত খেলাধুলা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করছিল।
“একজন মাজুর ব্যক্তি, যে পঙ্গু, হাঁটতে পারে না, চলতেও পারে না, সে নাকি প্রেসিডেন্টকে হুমকি দিয়েছে, ওই অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করল। আর স্কুল, বিভিন্ন শপিং মলে, রেস্তোরাঁয় অনবরত গুলি হচ্ছে, আর মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন কোনো দিন নাই বোধহয়, আমেরিকায় গুলি করে মানুষ না মারছে।”
অন্য জায়গায় মানবাধিকারের কথা বলেও ফিলিস্তিনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দুমুখো’ নীতির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “এটাতো আমারও প্রশ্ন। এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমরা করে আসছি। যে দুমুখো নীতি কিসের জন্য?
“মানুষ খুন করলে, তারপর তাদেরকে টাকাও দেওয়া হয়, অস্ত্রও দেওয়া হয় মানুষ হত্যায়। অপর জায়গায় দেখা গেল, মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার।”
দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমাদের দেশেওতো মানবাধিকারের কত বিরাট বিরাট প্রবক্তারা আছে, তারা এখন চুপ কেন? তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তারা চুপ কেন? কথা বলে না কেন?
“তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন। সাংবাদিক থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংস্থা, বাংলাদেশের বিষয়ে অনেক সোচ্চার, এখন কেন চুপ।”
সরকার আর মানবাধিকার সংস্থা চুপ থাকলেও সাধারণ মানুষ সোচ্চার হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নারী-শিশু হত্যা, হাসপাতালে বোমা হামলার প্রতিবাদে আজকে বিশ্ব জাগ্রত। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। আর তারা অ্যারেস্ট করছে। সেটাই নাকি তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।”
নিজে ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে সবসময় যুদ্ধের বিপক্ষে থাকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “যুদ্ধের ভয়াবহতা আমি নিজে দেখেছি। আমরা বন্দিখানায় ছিলাম আর শরণার্থী হিসাবে ছিলাম। আমি যেখানে সুযোগ পাই, আমার নিজের অভিজ্ঞতা ধরেই আমি মানুষকে বোঝানোর চষ্টা করি, কেন আমি এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে। কেন আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সব সমাধান করতে পারি না।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমাধান করতে পেরেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যুদ্ধের মূলে অস্ত্র উৎপাদন ও অস্ত্র বিক্রি থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি সেটাও বলেছি, এই অস্ত্র প্রতিযোগিতাটা বন্ধ করে সেই টাকাটা মানুষের কল্যাণে বা জলবায়ু ফান্ডে দিয়ে দেন। ফলে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত তারা লাভবান, তারা জীবন-জীবিকা বাঁচাতে পারবে।”
ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বাংলাদেশের জোরালো অবস্থানের বিষয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “ফিলিস্তিনিদের বিষয়েতো বললাম, আমরা সবসময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আছি। এবং আমি যেখানেই যাই, আমার কথা আমি বলবই। কারণ, সেখানে যেভাবে গণহত্যা চলছে, এটা অমানবিক।”
যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ দমনের বলপ্রয়োগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আপনারা দেখেছেন, আজকে ৯০০ ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক থেকে শুরু করে সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে এই আন্দোলন করার জন্য একমাত্র আমেরিকায়। আর এটা নাকি গণতন্ত্রের একটা অংশ। সেটাও আমাদের শুনতে হয়। যেভাবে একজন অধ্যাপককে জাপটে ধরে, মাটিতে ফেলে হ্যান্ডকাফ পরানো হল…।
“২০০১ সালের পর ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর বিএনপির সন্ত্রাসী, পুলিশ বাহিনী যেভাবে অত্যাচার করেছিল, সেই অত্যাচারের কথাটাই মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য, তাদের কাছ থেকে আমাদের মানবাধিকারের সবক নিতে হয়। এটাই হচ্ছে, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের।”
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর ‘গণহত্যার’ বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের অভিযানের মধ্যে এক হাজারের বেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছে বিবিসি।
এর মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলকারীদের ওপর ‘ভয়াবহ’ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলপন্থিরা। অন্যদিকে নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের বিষয়ে বিক্ষোভ দেখানোর বিষয়ে এক প্রশ্নে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, “যেখানে বিক্ষোভ হচ্ছে, সেখানেতো আমেরিকা সরকারের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ করছে। আমাদের এখানে আওয়ামী লীগ কার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করবে। আমরা আমাদের মতামত দিচ্ছি, আমরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিচ্ছি।
ফিলিস্তিনের শিশু-নারীদের জন্য তৃতীয় দফায় সহযোগিতা পাঠানোর প্রস্তুতি চলার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আন্তর্জাতিকভাবে আমরা সবসময় তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। যেখানে নির্যাতিত মানুষ, সেখানে বাংলাদেশ আছে, এটা আমি প্রমাণ করতে পারি।”