“তারা কি বোঝে না জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না? আমরা মনে করি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি না করে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা সম্ভব।”
Published : 02 May 2024, 07:54 PM
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভর্তুকি তুলে দিয়ে জ্বালানির দাম বাড়িয়ে সরবরাহ ব্যয় সমন্বয়ের যে পরামর্শ দিয়েছে, তার সঙ্গে একমত নয় কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা এ সংগঠন মনে করে, মূল্য বৃদ্ধি না করেই ভর্তুকি প্রত্যাহার সম্ভব। এই লক্ষ্য অর্জনে জ্বালানি খাতের ‘অস্বচ্ছতা, অপব্যয়, অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা’ দূর করাসহ ১৩টি পরামর্শ দিয়েছে তারা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ক্যাব আয়োজিত ‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা সুরক্ষায় মূল্যবৃদ্ধি নয়, জ্বালানি সুবিচার চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের পক্ষ থেকে এসব পরামর্শ তুলে ধরা হয়।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম লিখিত বক্তব্যে বলেন, ঋণ কর্মসূচির আওতায় পর্যবেক্ষণে আসা আইএমএফের প্রতিনিধি দল ২৫ এপ্রিল অর্থ বিভাগের বাজেট অনু-বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যুৎ গ্যাস ও সারে ভর্তুকি উঠিয়ে দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যয় সমন্বয়ের সুপারিশ করেছে।
“ভর্তুকির অর্থ (তারা) সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমে খরচ করার পরামর্শ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগ বলেছে, খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আপাতত কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেবে সরকার। বোঝা যায়, জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের মাথায় নেই। তারা কি বোঝে না জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না? আমরা মনে করি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি না করে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা সম্ভব।”
কীভাবে তা সম্ভব, তা ব্যাখ্যা করে শামসুল আলম বলেন, “বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা প্রতিরোধ করা গেলে এবং ন্যূনতম ব্যয় ও জ্বালানি সরবরাহ করার নীতি ও কৌশল গ্রহণ করা হলে বিদ্যুৎ খাতে বিদ্যমান ঘাটতি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মূল্য বৃদ্ধি সমন্বয় সম্ভব হত। কিন্তু এমন কোনো পরামর্শ তো আইএমএফ-এর নিকট থেকে আসে না। অবশ্য কখনো আসবেও না। কারণ আইএমএফ ও এর মত দাতা সংস্থারা বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি বাজারে রূপান্তর করার লক্ষ্যে সরকারকে ঋণ ও ঋণের শর্তে আটকে ফেলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গত বছরের হিসাবে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় ছিল ঘরপ্রতি ৭ টাকা ৮৩ পয়সা। অথচ উৎপাদন ব্যয় কমবেশি ১২ টাকা আর বিক্রি করে পিডিবি পায় ৭ টাকা ৪ পয়সা।
“অচিরেই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে পাশাপাশি আমদানি করে ভর্তুকি কমানো হবে; লুণ্ঠনমুলক ব্যয় বৃদ্ধিতে লাগাম টানা হবে না। জনগণ লুণ্ঠিত হবে, ভোক্তারা জ্বালানি সুবিচার পাবে না।"
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, “ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ প্রতিষ্ঠার শতবছর পার হয়ে গেছে। এই শত বছরে তারা সারা পৃথিবীর বহু দেশকে ঋণ দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশ বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের শর্ত মেনে ঋণ নিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে, সংকট থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে, নিষ্কৃতি পেয়েছে– এমন কোনো উদাহরণ এক শতাব্দীতেও পাওয়া যায়নি।
“এই কথাটি আমাদের সকলের মনে রাখা দরকার। বিশেষ করে নাগরিক, নাগরিক সমাজ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারকে মনে রাখা দরকার। অতএব তাদের শর্ত পূরণ করার জন্য জনগণের ঘাড়ে বোঝার পর বোঝা চাপাবেন, এটা অনেক করেছেন, অনেক অন্যায় করছেন, এই অন্যায় আর বাড়াবেন না।”
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “আমরা ঋণ নিয়েছি কেন? আমাদের অর্থনীতি প্রায় খালির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সেই হিসাবে আইএমএফ আমাদের ঋণ সহায়তা দিয়েছে। এখন আইএমএফের কাছে আমাদের দাবি, আপনারা ন্যায়সঙ্গত পরমর্শ দেবেন।
“আপনারা পরামর্শ দিয়েছেন, ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে ভুর্তুকি হ্রাস করার। কিন্তু আপনারা বলছেন না, এটির কোনো বিকল্প আছে। আপনারা দেখছেন না, পরীক্ষা করছেন না– এটির কোনো বিকল্প আছে কিনা। আমাদের ধারণা, অস্বচ্ছতা, অপচয়, অমীতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা রোধ করে যদি স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, তাহলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি না করেই ভর্তুকি প্রত্যাহার করা সম্ভব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফ উভয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী একসময় একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। যার নাম ছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিটি। তাদের নীতি ছিল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির আগে একটি গণশুনানি হবে। তাতে তিনজন স্টেকহোল্ডার উপস্থিত থাকবেন; প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি এবং কনজ্যুমার প্রতিনিধি।
“সেখানে প্রত্যেকে যুক্তি উপস্থাপন করবেন কেন দাম বাড়ানো হবে; কেন কমানো হবে। তারপর কমিশন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। প্রশ্ন হল, কেন এটি বিলুপ্ত করা হল? ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফ কেন তখন শর্ত দিল না যে, এটি নিস্ক্রিয় করলে আমি আর ঋণ দেব না।"
জ্বালানির মূল্য না বাড়িয়ে ভর্তুকি প্রত্যাহারে সরকারের প্রতি ১৩টি পরামর্শ দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে।
• বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতাবিহীন যে কোনো বিনিয়োগ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করতে হবে।
• বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০১০ রদ করতে হবে। এবং ২০০৩ সালের বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইনের সংযোজিত ধারা সংশোধনক্রমে ৩৪-এর ‘ক' ধারা রহিত হতে হবে।
• গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল ও জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থ যথাক্রমে বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধান, পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি আমদানিতে ঋণ নয়, ভোক্তার ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হতে হবে।
• মুনাফাব্যতীত কস্ট বেসিসে ৫০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন সরকারের একক মালিকানায় হতে হবে। কস্ট প্লাস নয়, সরকার শুধু কস্ট বেসিসে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সেবা দেবে।
• প্রাথমিক জ্বালানি মিশ্রণে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় এলএনজি, কয়লা ও তেলের অনুপাত কমাতে হবে। নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও মজুদ বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি নিয়ন্ত্রণে রেখে আমদানি ব্যায় কমাতে হবে।
• সরকার ব্যক্তি খাতের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হবে না এবং মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ার ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয় তেল শোধনাগার এস আলম গ্রুপের সঙ্গে নয়, সরকারের একক মালিকানায় হতে হবে।
• বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতভুক্ত সরকারি এবং যৌথ মালিকানাধীন সকল কোম্পানির বোর্ড থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের আমলাদের প্রত্যাহার করতে হবে।
• নিজস্ব কারিগরি জনবল দিয়ে স্বাধীনভাবে উভয় খাতের কোম্পানি বা সংস্থার কার্যক্রম পরিচালিত হতে হবে। সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় শুধু বিধি ও নীতি প্রণয়ন এবং আইন বিধি-প্রবিধান অনুসরণ ও রেগুলেটরি আদেশগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসনিক নজরদারি, সনদধারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। আর রেগুলেটর হিসেবে বিইআরসিকে সক্রিয়, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে।
• জলবায়ু তহবিলসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নয়, ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে হবে। সে ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্তদের সক্ষমতা উন্নয়ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজার সম্প্রসারণে আইন করে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
• বিদ্যুৎ, জীবাশ্ম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন নীতির আইন, বিধি-বিধান ও পরিকল্পনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্পাদিত প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
• বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়নে সকল চুক্তি আইনি প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত মডেল চুক্তির মত হতে হবে।
• ইতোমধ্যে বাপেক্স ও স্যান্টোসের মধ্যে মগনামা-২ অনুসন্ধান কূপ খননে সম্পাদিত সম্পূরক চুক্তি, আরইবি ও সামিট পাওয়ারের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি, পিডিবি ও সামিট পাওয়ারের মধ্যে মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্ট-এর বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি, পিডিবি আদানির মধ্যে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিসহ সব জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে। ১৯৯৪ সালের জ্বালানি সনদ চুক্তি স্বাক্ষরে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।
• জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে বিদ্যুতে জ্বালানির মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য এনার্জি প্রাইস স্ট্যাবিলাইজড ফান্ড গঠন করতে হবে।
অন্যদের মধ্যে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।