বাংলাদেশে সাংবাদিক হিসাবে কর্মরত যুক্তরাজ্যের নাগরিক ডেভিড বার্গম্যানকে জরিমানার দণ্ডে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিদাতা ৫০ ব্যক্তির মধ্যে ২৫ জনের বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ১ এপ্রিল দিন ঠিক করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
Published : 18 Mar 2015, 04:41 PM
বুধবার এই ২৫ নাগরিকের বিষয়ে আদেশ দেওয়ার কথা থাকলেও ১০ জন আবার সময় চেয়ে আবেদন করায় তা পিছিয়ে দেয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২।
তবে বিবৃতিদানকারী ব্যক্তিরা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বারবার সময় নেওয়ার পাশাপাশি তাদের দেওয়া ব্যাখ্যায়ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান।
বুধবার সময় আবেদন করেন যে আটজন, তারা হলেন- মাসুদা খান, আফসান চৌধুরী, জিয়াউর রহমান, হানা শামস আহমেদ, আনু মুহাম্মদ, আনুশেহ আনাদিল, লুবনা মরিয়ম, মুক্তাশ্রী চাকমা, ফরিদা আখতার ও রেজাউর রহমান।
তাদের পক্ষে সময় আবেদন করেন ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন। ফরিদা আখতারকে দেশের বাইরে যেতে হওয়ায় বুধবার তার নামে ওকালতনামা দাখিল করেন ব্যারিস্টার আসাদ।
নিজেদের শুনানি নিজেরাই করার কথা জানানো পাঁচ বিবৃতিদাতার পক্ষে নারী অধিকারকর্মী শিরীন হক ট্রাইব্যুনালকে জানান, তারা নিজেরাই নিজেদের দাখিলকৃত ব্যাখ্যার শুনানি করার কথা বলেছিলেন। তবে উপযুক্ত আইনি ব্যাখ্যা দাখিল করার জন্য তারা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আখতার ইমামের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
শিরীন হক ছাড়া বাকি চারজন হলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, নৃ-বিজ্ঞান গবেষক রেহনুমা আহমেদ ও আলোকচিত্রী শহীদুল আলম।
বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ চলায় বুধবার অবকাশ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়ের আবেদন করেন শিরীন হক।
এসময় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, “আপনাদের এক্সপ্ল্যানেশনের শুনানির কোনো সুযোগ নেই। আর সময় দিতে পারব না। আপনারা এক্সপ্ল্যানেশন দিয়েছেন, তা সন্তোষজনক নয়।
“আপনারা আবার সময় চাচ্ছেন এই বলে যে আপনারা আপনাদের এক্সপ্ল্যানেশনে স্ট্যান্ড করেন। আপনারা একজন ছয় সপ্তাহ সময় চান, আরেকজন বলেন সুপ্রিম কোর্টের ভ্যাকেশনের পর। আমরা কি বসে থাকব? আমরাও তো সুপ্রিম কোর্টের জাজ। ছুটিতে তো আমরাও এখানে বসে কাজ করছি, আর আমাদের ব্রাদার জাজরা ছুটি কাটাচ্ছেন।”
এরপর শিরীন হককে উদ্দেশ করে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, “একবার বলেন পারসোনালি অ্যাপিয়ার করবেন, আবার বলেন আপনাদের হয়ে আখতার ইমাম অ্যাপিয়ার করবেন।
“আপনাদের কথায় কি কোর্ট চলবে? কোনো সময় পাবেন না। আজকেই অর্ডার দিব।”
এরপর রোববার পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করে দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এসময় আইনজীবী আসাদ উদ্দিন আবার নিজের ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সময় আবেদন করলে ১ এপ্রিল পরবর্তী দিন নির্ধারণ করে ট্রাইব্যুনাল।
সেইসঙ্গে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, “এটাই লাস্ট চান্স, যা বলার সেদিন বলবেন। এরপর কোনো সময় দিব না।”
৫০ নাগরিকের মধ্যে মানবাধিকার কর্মী ও নারীনেত্রী খুশি কবির ওই বিবৃতি প্রকাশের পরপরই নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ১৪ জনের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করলে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় আদালত।
ওই দিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক, নাগরিক সংগঠন সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান, সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ও আমেনা মহসিন, বাংলাদেশ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর ডা. নায়লা জামান খান, ড. শাহনাজ হুদা, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল, মানবাধিকারকর্মী জাকির হোসেন, সংগীত শিল্পী অরূপ রাহী, লেখক শাহীন আক্তার এবং অধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান আদালতের ক্ষমা পান।
লেখক তাহমিমা আনাম সেদিন ব্যাখ্যা দাখিল করলেও তার ক্ষমা প্রার্থনার ভাষা সঠিক না হওয়ায় সেদিন তাকে অব্যাহতি দেয়নি আদালত।
এরপর ৩ মার্চ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনাকারী আরও ১০ জন নাগরিককে ক্ষমা করে আদালত। এরা হলেন- ড. আলী রীয়াজ, ড. পারভিন হাসান, ফিরদৌস আজিম, মহিউদ্দিন আহমেদ, ড. ফস্টিনা পেরেরা, নূর খান লিটন, ড. সামিয়া হক, ড. সেঁউতি সবুর, তাসমিন সারা সাহাবুদ্দীন ও তাহমিমা আনাম।
ব্লগে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ লেখার মাধ্যমে বিচারাধীন বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর দায়ে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে গত ২ ডিসেম্বর সাজা দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২০ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলো ৫০ নাগরিকের উদ্বেগ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।
ওই সংবাদ ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রতি কটাক্ষ’ বলে মনে হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল প্রথম আলোর কাছে ওই বিবৃতির ‘পূর্ণাঙ্গ কপি’ দেখতে চায়। সে অনুযায়ী প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ ওই ৫০ নাগরিকের পক্ষে বিবৃতি পাঠানো হানা শামস আহমেদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ও ঠিকানা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে।
আদালতের নির্দেশে বিবৃতিদাতা ৫০ নাগরিকের মধ্যে ৪৯ জনের পরিচয় ও ঠিকানা গত ১৪ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। নাম-ঠিকানা পাওয়ার পর বিচারক বিবৃতিদাতাদের আচরণের ব্যাখ্যা দিতে বলেন।
বাকি বিবৃতিদাতাদের মধ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ কয়েকজন ট্রাইব্যুনালে নিজের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, তারা নিজেরাই এর ওপর শুনানি করবেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছিলেন, বিবৃতিতে যা লেখা হয়েছে তাতে আদালত অবমাননার মতো কিছু ছিল না বলে তিনি মনে করেন।
বিবৃতিদাতা বাকিরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক সি আর আবরার, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক বীণা ডি কস্টা, সাংস্কৃতিককর্মী লিসা গাজী, দিনা এম সিদ্দিকী, জারিনা নাহার কবির, লেখক শবনম নাদিয়া, লেখক মাহমুদ রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসরিন সিরাজ এ্যানি, আলাল ও দুলাল ব্লগের সম্পাদক তীব্র আলী, নৃবিজ্ঞানী দেলোয়ার হোসেন।