শিশুদের বেলুন বাঁশির আওয়াজ, খেলাধুলা, নাচ-গান-আবৃত্তিতে রোববার দিনভর মুখর ছিল বঙ্গভবন চত্বর, বিভিন্ন বয়সী শিশুদের সঙ্গে এদিন অন্যরকম সময় কাটালেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
Published : 28 Dec 2014, 09:16 PM
ঢাকা, গাজীপুর, রংপুর, খাগড়াছড়িসহ ১১টি জেলার ২৬০জন শিশুকে নিয়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে শিশুদের মিলনমেলা’য় ছিল সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও।
দুপুরের আগে থেকেই বঙ্গভবনের মাঠ মুখর হয়ে ওঠে শিশুদের উচ্ছ্বাসে। ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের জন্য আয়োজন করা হয় বাঘের মুখে বল ছোড়া, দৌড় প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা।
এরপর শিশুদের সঙ্গেই দুপুরের খাবার খান রাষ্ট্রপতি। পরে বঙ্গভবনের দরবার হলে শিশুদের সঙ্গে প্রাণবন্ত কথোপকথনে মেতে ওঠেন তিনি, ফিরে যান নিজের শৈশবে।
কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা আবদুল হামিদ স্মৃতিচারণ করেন শৈশবের মধুর দিনগুলোর। নিজের জন্মভূমিতে ইচ্ছামতো যেতে না পারার ব্যথার কথাও জানান ‘কচিকাঁচা’দের।
এসময় ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শিশুদের দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসার উপদেশ দেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির সান্নিধ্যে শিশুরাও ভেসে যায় আবেগে।
মূল অনুষ্ঠানের আগে আজিমপুর শিশু বিকাশ কেন্দ্রের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা আফরিন স্মৃতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে, “কখনও ভাবিনি আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সময় কাটাবো। এমন দিনের জন্য আমি খুব আনন্দিত।”
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথোপকথনে সামাহ নামের এক শিশু তার শৈশব সম্পর্কে জানতে চায়।
এসময় স্বভাবসুলভ হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে আবদুল হামিদ বলেন, “আজ আমি ছাত্র, তোমরা শিক্ষক। তোমরা প্রশ্ন করবে, আর আমি উত্তর দিব।”
নিজের শৈশবের কথা বলতে গিয়ে কিছুটা আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়েন রাষ্ট্রপতি।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এসময় শিশুদের জন্য হাওর সফরের আয়োজন করার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।
নূরে তাবাসসুম নামের এক শিশু জানতে চায়, “আপনি কি গ্রামের বাড়ি যান? নাকি সবসময় এখানে থাকেন?”
এ প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আমি সবসময় যেতে চাই, কিন্তু আমাকে যেতে দেওয়া হয় না। মনটা আমার গ্রামেই পড়ে থাকে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। যেতে গেলেও অনেক সমস্যা। দেড়-দুই হাজার লোক যেতে হয়।
“কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের কামালপুরে আমার বাড়ি। পাশে নদী আর সামনে বিল। সবসময় মন পড়ে থাকে সেখানে।”
বর্ষায় হাওরের উথাল-পাতাল ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালী আর সংগ্রামের কথাও তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি।
“নৌকায় করে পাড়ি দিয়েছি দ্বীপের মতো এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে, এক গঞ্জ থেকে আর এক গঞ্জে। দেখেছি হাওরের মানুষের সংগ্রামী জীবন। দেখেছি মাছ ধরার রকমারি দৃশ্য। সেসব মাছের সোনালী-রুপালি রং আজও আমাকে মুগ্ধ করে।”
গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে শিশুদের পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, “এই সব না দেখলে তোমরা বঞ্চিত হবে গ্রামবাংলার প্রকৃত রূপ থেকে, বাংলার প্রাণ থেকে। কারণ এগুলোই আমাদের শিকড়, বেঁচে থাকার মূল উপজীব্য।”
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম দেখা, নিজের দীর্ঘ রাজনীতি-জীবনের স্মৃতিচারণ করে শিশুদের দেশপ্রেমের চেতনায় গড়ে ওঠার পরামর্শও দেন তিনি।
এসময় শাহজাহানপুর রেল কলোনির পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের পাইপে চারবছর বয়সী শিশু জিহাদের করুণ মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি।
“গতকাল এক দুর্ঘটনায় তোমাদের বয়সী এক শিশু জিহাদ মারা গিয়েছে। তার মৃত্যুতে জাতি মর্মাহত। আমি তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।”
শিশুদের সান্নিধ্যে তিনি যে কতটা আনন্দিত, তা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, “তোমাদের সাথে বঙ্গভবনে সময় কাটাতে পেরে আমার খুবই ভালো লাগছে। তোমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তোমরা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে একান্তে মিলিত হতে পারছ, তোমাদের মনের কথা বলতে পারছ।
“এটি তোমাদের জীবনের এক স্মরণীয় ও বিরল মুহূর্ত। তোমাদের সাথে আলাপচারিতায়, তোমাদের গান-নাচ-অভিনয়-আবৃত্তি শুনে আমি খুবই খুশি হয়েছি।”
ভবিষ্যতে শিশুদের সঙ্গে আবারও এরকম সুন্দর সময় কাটানোর ইচ্ছাও প্রকাশ করেন তিনি।
“বঙ্গভবনে শিশুদের সাথে রাষ্ট্রপ্রধানের একটি দিন কাটানোর যে শুভ সূচনা হলো, তা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে-এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।”
শৈশবে এরকম সময় কাটানোর কথা যে তাদের কল্পনাতেও ছিল না, সে কথাও বলেন আবদুল হামিদ।
“তোমাদের এ বয়সে আমরা ছিলাম পরাধীন দেশের নাগরিক। বঙ্গভবনের মতো রাজদরবারে আসার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। আমাদের না ছিল কথা বলার স্বাধীনতা, না ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সংস্কৃতি চর্চাও ছিল রীতিমতো কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
স্বাধীন বাংলাদেশ শিশুদের বিকাশের জন্য যে সুযোগ এনে দিয়েছে তার সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি আত্মস্থ করার পরামর্শও দেন রাষ্ট্রপতি।
“তথ্য-প্রযুক্তির প্রসারে সারা বিশ্ব আজ হাতের নাগালে এসেছে। এ যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ছোঁয়া দিলেই জ্ঞানের দৈত্য এসে হাজির। কম্পিউটারে একটা ক্লিকে বিশ্বের সব তথ্য মুহূর্তে তোমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। আমি চাই, তোমরা এ প্রযুক্তিকে ভাল কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।”
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক সচিব জনাব তারিক-উল-ইসলাম, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন।
এর আগে শিশুদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন রাষ্ট্রপতি। এই অনুষ্ঠানে ছিল দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, লালনগীতি, নৃত্য নাট্য, আদিবাসী নৃত্য।