রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মোট ১৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ, এদের মধ্যে স্থানীয় একটি কলেজের এক অধ্যক্ষও রয়েছেন।
Published : 17 Nov 2014, 12:19 AM
কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা এখনো স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে। তবে ফেইসবুকে ‘আনসার আল ইসলাম’ নামে খোলা একটি পাতায় এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকারের পর নিহতের ছেলেও জঙ্গিদেরই দায়ী করেছেন।
এদিকে সহকর্মী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রোববারের পর সোম-মঙ্গলবারও ক্লাস বর্জনের কর্মসূচি দিয়ে খুনিদের গ্রেপ্তারে সরকারকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে। তবে এতে আসামি হিসেবে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।
অধ্যাপক শফিউল হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। তারা খুনিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
শনিবার বিকালে ক্যাম্পাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাইয়ে নিজের বাসায় ফেরার পথে সড়কে হামলার শিকার হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল, যিনি বাউল সাধক লালনের ভক্ত ছিলেন।
রোববার দুপুরের পর তাকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শালমারা ইউনিয়নের হিয়াদপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তার বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়।
এই অধ্যাপকের খুনিদের গ্রেপ্তারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর পুলিশ রাতেই দুজনকে আটক করে। রোববার দিনভর আরো ১৩ জনকে আটক করা হয় বলে মতিহার থানা পুলিশ জানিয়েছে।
আটকদের মধ্যে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুন আহমেদের নাম জানা গেলেও বাকিদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ।
মতিহার থানার ওসি আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে বিনোদপুর থেকে ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ুনকে আটক করে।
জামায়াতে ইসলামীর শক্ত অবস্থান রয়েছে বিনোদপুর এলাকায়। ওই এলাকায় আহলে হাদিসের সক্রিয়তাও রয়েছে, যে সংগঠনটির প্রধান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক শিক্ষক আসাদুল্লাহ আল গালিব বতর্মানে কারাগারে রয়েছেন।
অধ্যক্ষ হুমায়ুনকে আটকের অভিযানে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরো ১২ জনকে রাজশাহীর বিনোদপুর ও হত্যাকাণ্ডের স্থান বিহাস পল্লীর আশেপাশের এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে বলে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আব্দুল মজিদ জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“তাদেরকে আটক করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।”
মতিহার থানার ওসি আলমগীর জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক এন্তাজুল হক বাদী হয়ে রোববার রাতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কারো নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাতনামা অনেককে আসামি করা হয়েছে।
‘দায়ী জঙ্গিরা’
গাইবান্ধায় পারিবারিক কবরস্থানে বাবাকে দাফনের পর অধ্যাপক শফিউলের ছেলে সৌমিন সাহরিদ জাভিন বলেন, “আমার বাবার হত্যাকাণ্ডে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলো জড়িত। আমি আমার বাবার হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র সৌমিনের এই বক্তব্যের আগে ফেইসবুকের একটি পাতায় অধ্যাপক শফিউলকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়।
শনিবার অধ্যাপক শফিউল ইসলাম লিলন খুন হওয়ার পাঁচ ঘণ্টা পর আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামে ওই ফেইসবুক পাতাটি খোলা হয়।
এতে বলা হয়েছে, “উই আর দি হেল্পারস অব শরিয়া ইন বাংলাদেশ। উই আর মুজাহিদিন সাবিলিল্লাহ।”
ওই পোস্টে কালো পশ্চাৎপটে শফিউল ইসলামের ছবি দিয়ে তার ওপর লাল রঙে আড়াআড়ি ‘ক্রস’ চিহ্ন দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে।
ছবির নিচে লেখা হয়েছে- ‘এ কে এম শফিউল ইসলাম (ফাইল ক্লোজড)/ অপরাধ এপ্রিল ২০১০/ শাস্তি প্রদান নভেম্বর ২০১৪’।
আনসার আল ইসলাম নামে বাংলাদেশে কোনো সংগঠনের কার্যক্রম আছে কি না- সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা থাকতেও পারে। পুলিশ সব বিষয়ই খতিয়ে দেখছে।
তিনি দুপুরে সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “গোয়েন্দারা বিভিন্ন মোটিভ নিয়ে মাঠে কাজ শুরু করেছে। এটা পলিটিক্যাল হতে পারে, আবার জঙ্গিদের কাজও হতে পারে। কোনো কিছু সুনির্দিষ্ট করে এখনই বলা যাবে না।”
মাথা ও ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল অধ্যাপক শফিউলের। ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত বছর ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার এবং ১০ বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসকেও একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছিল।
ইউনূস হত্যাকাণ্ডে দুই জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। রাজীব হত্যাকাণ্ডে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিনের বিচার চলছে।
ওসি আলমগীর বলেন, অধ্যাপক শফিউলের ওপর হামলায় দুইজন অংশ নিয়েছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন।
শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি
সহকর্মী খুনের প্রতিবাদে রোববার সব ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাসে পদযাত্রা ও শোক সমাবেশ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানান তারা।
সমাবেশে মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শাহ আজম বলেন, “আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একদিকে শোকাহত, অন্যদিকে শঙ্কিত। যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে, তাদের যদি এভাবে হত্যা করা হয় তাহলে সেটা কোনো ব্যক্তি নয়,বিশ্ববিদ্যালয়কে হত্যা করা হয়।”
সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে সভার পর শিক্ষক সমিতি পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারে সরকারকে সময় বেঁধে দেয়।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রণব কুমার পাণ্ডে সাংবাদিকদের বলেন, এই সময়ের মধ্যে খুনিরা গ্রেপ্তার না হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
শিক্ষক সমিতি সোম ও মঙ্গলবার ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সমাবেশ করবে।
এছাড়া আগামী ১৯ নভেম্বর রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছে তারা।