কারখানা ভবনের সাত তলায় যে ফিনিশিং টেবিলে কয়েকদিন আগেও কর্মব্যস্ত দিন কাটত, সেখানে এখন হাতে স্যালাইনের সুঁই নিয়ে শুয়ে আছেন কয়েকজন শ্রমিক।
Published : 30 Jul 2014, 08:27 PM
অনশনক্লিষ্ট মুখ নিয়ে কয়েকজন বসে আছেন টেবিলের ওপরে, কেউবা মেঝের ওপরই শুয়ে পড়েছেন।
একটি কক্ষের দেয়ালে ব্যানার টাঙিয়ে তিন মাসের বকেয়া বেতন আর ঈদ ভাতার দাবিতে চলছে বক্তৃতা। আর নবম তলায় ‘প্যাকেজিং রুমে’ কার্যত জিম্মি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন কারখানা মালিকের শাশুড়ি লাইলী বেগম।
শ্রমিকদের পাহারার মধ্যে তাদের দেয়া খাবারই তিনি খাচ্ছেন। এক নারী শ্রমিকের শাড়ি গায়ে দিয়ে ছোট্ট ওই ঘরে মেঝের ওপরই ঘুমাচ্ছেন।
১২ তলা কারখানা ভবনের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে পুলিশের একটি গাড়ি। নিচতলায় মার্কেটের সামনে একদল পুলিশ রয়েছেন সতর্ক অবস্থায়।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় হোসেন মার্কেট নামে পরিচিত তোবা গ্রুপের এই ভবনে ঈদের আগের রাত থেকে তিন দিন ধরে অনশন চালিয়ে আসছেন তিন শতাধিক পোশাক শ্রমিক।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ, পুলিশ প্রশাসন বা গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ কোনো সমাধান দিতে পারেনি।
এই পরিস্থিতিতে সরকারকে দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ করার কথা জানিয়ে বিজিএমইএর লেবার স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ আলী আনসারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আসলে দুঃখিত। তারা ঈদ করতে পারেননি, অনশন করছেন।”
দেড় বছর আগে এই গ্রুপের কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিক নিহত হন। অব্যস্থাপনার মাধ্যমে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার অভিযোগে কারখানা মালিক দেলোয়ার হোসেন বর্তমানে কারাগারে।
মে, জুন ও জুলাই মাসের বেতন, ওভারটাইম ও ঈদ বোনাসের দাবিতে কয়েকদিন আগে থেকেই বিক্ষোভ করে আসছিলেন তোবা গ্রুপের পাঁচটি কারখানার দেড় হাজারেরও বেশি শ্রমিক। বিজিএমইএ বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও সমাধান দিতে ব্যর্থ হলে শ্রমিকদের সেই আন্দোলন অনশনে গড়ায়।
‘সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত অনশন’
তোবা ফ্যাশনসের কাটিং সুপারভাইজার মুজিবুর রহমান বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে অনশন চালিয়ে আসা কর্মীদের মধ্যে প্রতিদিনই ১০-১২ জন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
তাদের কাউকে কাউকে কারখানা ভবনেই স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। কাউকে আবার পাঠানো হচ্ছে মগবাজারের কমিউনিটি হাসপাতালে। একটু সুস্থ বোধ করলেই তারা আবার কারখানায় ফিরে আসছেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের নেত্রী মোরশেফা মিশু প্রথমদিন থেকেই শ্রমিকদের সঙ্গে অনশনে অংশ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, “যতোদিন শ্রমিকরা বকেয়া বেতন না পাবে, ততোদিন আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
অনশনে অংশ নেয়া তোবা ফ্যাশনসের সুইং বিভাগের সুপারভাইজার মোহাম্মদ সোহাগ বলেন, “বিশ্বকাপে এবার আমরা ২৬ কোটি টাকার কাজ করেছি। তারপরও মালিক ব্যবসায় ক্ষতির কথা বলছে। এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য না।”
সরকারের দিকে তাকিয়ে বিজিএমইএ
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর কর্তারা এর আগে তোবা গ্রুপের সমস্যার সমাধানে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেন। বকেয়া পরিশোধের জন্য কয়েক দফা তারিখও দেন। কিন্তু টাকা পাননি শ্রমিকরা।
গত ২৩ জুলাই তোবার পাঁচটি কারখানার শ্রমিকরা বিজিএমইএ ভবনের সামনের সড়কে বিক্ষোভ করার পর সংগঠনের লেবার স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ আলী আনসারি বলেন, “ব্যাংকে টাকা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই টাকা তোবা গ্রুপেরই অন্য কারখানা চালাকি করে ব্যাংক থেকে নিয়ে যায়। ফলে এসব কারখানার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।”
এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে বুধবার বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম ও সহ সভাপতি এস এম মান্নান কচির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পরে আহাদ আলী আনসারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। সরকার আমাদের বলেছিল, তোবা গ্রুপের কোনো একটি ভবনের ফ্লোর বিক্রি করে হলেও বেতন পরিশোধ করে দিতে। আমরা একটি ফ্লোর বিক্রির উদ্যোগ নিয়েও পরে জানতে পারি সেটি যমুনা ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা আছে।”
এরপর বাড্ডায় তোবা গ্রুপের আরেকটি টিনশেড কারখানা বিক্রির চেষ্টা করেও ক্রেতা পাননি বলে জানান এই বিজিএমইএ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “আমরা বিজিএমইএর নিজস্ব তহবিল থেকে তোবার বকেয়া পরিশোধের কথাও ভেবেছি। কিন্তু সেখানে যে অংকের টাকা আছে তাতে অল্প কয়েকজনকেই কেবল বেতন-ভাতা দেয়া যেত। তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো।”
বর্তমানে তোবার শ্রমিকদের সঙ্গে আন্দোলনে থাকা কয়েকটি সংগঠনকে নিয়ে ওই টিনশেড কারখানাটি বিক্রি করে যতো দ্রুত সম্ভব সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা চলছে বলে জানান আহাদ।
তিনি বলেন, “আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি, যে কোনো উপায়ে এই বেতন-ভাতা পরিশোধের উদ্যোগ নেয়া হোক। প্রয়োজনে সরকারই এর দায়িত্ব নিক।”
পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার নুরুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ পর্যন্ত তো ঈদের ছুটি ছিল। তাই তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। কাল থেকে অফিস খুলবে। আশা করছি একটা সমাধান খুঁজে পাওয় যাবে।”