ইসলামী জঙ্গিবাদ প্রচারকারী এক ব্লগারের উস্কানিতে পুলিশ চট্টগ্রামের দুই এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
Published : 02 Apr 2014, 09:23 PM
চট্টগ্রাম কলেজের দুই পরীক্ষার্থী কাজী মাহমুদুর রহমান রায়হান রাহী (১৮) ও উল্লাস দাসকে (১৮) গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকা থেকে বিতর্কিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর পরদিন তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
ইন্টারনেটে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে প্রচারকারীদের অভিযোগ বলছেন, জামিনে থেকে সবসময় একে-তাকে হত্যার হুমকি দিলেও সফিউর রহমান ফারাবীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও ফারাবী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীদের ইন্ধনে পুলিশ দুই কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে।
রাহীর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ছাত্রশিবিরে যোগ না দেয়ায় এর ঘাঁটি বলে পরিচিত চট্টগ্রাম কলেজের এই ছাত্রকে পুলিশে দিয়েছে সংগঠনটির কর্মীরা।
অনলাইন একটিভিস্টরা বলছেন, ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক ড. অভিজিৎ রায়ের একটি ব্লগের নিন্দা করে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ফেইসবুকে একটি পাল্টা পোস্ট লেখেন ফারাবী শফিউর রহমান।
ফারাবীর পোস্টে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেককেই অভিজিৎ রায়কে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যায়।
এক পর্যায়ে ফারাবী লেখেন, “অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে। (৩৯তম মন্তব্য)
ফারাবী রাহীর কমেন্ট মুছে ফেলছেন বলেও কয়েকটি কমেন্টে অভিযোগ করেন এই কিশোর।
১৩ ফেব্রুয়ারির পর ওই পোস্টে রাহীর আর কোনো মন্তব্য দেখা যায়নি।
রাহী ও উল্লাস গত ৩০ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে থেকে বেরিয়ে পাশের প্যারেড ময়দান পেরিয়ে টাক শাহ মিয়া মসজিদের সামনে পৌঁছালে তাদের গতিরোধ করে কয়েকজন যুবক।
রাহী ও উল্লাসের একাধিক সহপাঠীর দাবি, কলেজের শিবিরকর্মীরা এই দুজনের গতিরোধ করে।
সহপাঠীরা দাবি করেন, ফেইসবুকে মন্তব্যের বিষয়গুলো আলোচনায় তুলে স্থানীয় জনতাকেও উত্তেজিত করে তোলে শিবিরকর্মীরা। রাহী ও উল্লাসকে তখন বেদম মারধর করা হয়।
দুইজনের বিরুদ্ধে পুলিশের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, “গত রোববার দুপুর ২টার দিকে দুই জন যুবককে প্যারেড মাঠের পূর্ব পাশে টাক শাহ মিয়া মসজিদের সামনের রাস্তায় আটক করে ৫০-৬০ জন যুবক মারধর করেছে।”
তাৎক্ষণিকভাবে ‘উত্তেজিত জনতার’ কবল থেকে দুই জনকে উদ্ধার করে পুলিশ।
ওই দিনই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ‘ইলেকট্রনিক ফোরামে মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও এর দণ্ড’ শিরোনামের ৫৭ (১) ধারা অনুসারে মামলা করা হয় দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।
দেশের অধিকার ও মানবাধিকারকর্মীরা এই ধারাটিকে কালো আইন অভিহিত করে এটি বাতিলের জন্য আন্দোলন করে আসছে।
রাহীর বাবা মাহফুজুর রহমানের অভিযোগ, শিবিরে যোগ না দেয়ার জন্যই তার ছেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ অভিযোগ আনা হয়েছে।
“সে শিবিরে যোগ দিতে রাজি হয়নি। তাই তারা তাকে পরীক্ষা দিতে দেবে না বলে হুমকি দেয়। পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনতেই সে সেদিন কলেজে গিয়েছিল।”
রাহীকে মারধর করে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন মাহফুজুর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উল্লাসের এক নিকটাত্মীয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উল্লাস এসব বিষয়ে সম্পৃক্ত নয়। রাহীর বন্ধু হওয়ায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে।”
আক্রান্ত রাহী এবং উল্লাসকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারেনি পুলিশ।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা) বাবুল আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ধর্মীয় উস্কানি দেয়ার জন্য তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে থানা ভালো বলতে পারবে। আমি তেমন কিছু জানি না।”
এজাহারে রাহী এবং উল্লাসকে মারধর করা হয়েছে উল্লেখ করা হলেও চকবাজার থানার ওসি আতিক আহমেদ চৌধুরী চৌধুরী বলেন, “মারধর নয় বরং সেদিন ‘একটু কথাকাটাকাটি’র ঘটনা ঘটেছিল।
“ফেইসবুকে তারা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দিয়ে লেখালেখি করে আসছিল। রাহী ও উল্লাসের কয়েকজন বন্ধু তাদের এসব লেখালেখি করতে মানা করে। কিন্তু তারা তা না করায় সেদিন তাদের সঙ্গে একটু কথাকাটাকাটি হয়।”
সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন পুলিশ সদস্য বিষয়টি জানালে দুজনকে থানায় আনা হয় বলে ওসি জানান।
রাহী এবং উল্লাস কী ধরনের লেখালেখি করেছিল- জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা আতিক বলেন, “তারা খুব খারাপ কথা লিখেছে, এগুলো জনসম্মুখে আনা যাবে না।”
ফারাবীর উস্কানির বিষয়টি নজরে আনলে তিনি বলেন, “আমি তাকে চিনি না, নাম শুনেছি। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।”
ফারাবীর উস্কানি
রাহী ও উল্লাসকে নাস্তিক দাবি করে গত ৩১ মার্চ রাত ১২টায় ফারাবী ফেইসবুকের উস্কানি দেয়ার কথা স্বীকার করেন।
“আমার এই স্ট্যাটাস এ কাজী রায়হান রাহীর কমেন্ট দ্বারাই আজকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।”
একই স্ট্যাটাসে ফারাবী আরো বলেন, “এখন সময় এসেছে যেইসব নাস্তিক আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে নিয়ে অশ্লীল কথা বলবে তাদের কে থাবা বাবার (ব্লগার রাজীব হায়দার) ন্যায় তিলতিল মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করা। বাংলাদেশে হয় আমরা মুসলমানরা বেঁচে থাকব নয় নাস্তিকরা বেঁচে থাকবে।’
এর আগে, গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য সেনাবাহিনীকে অভ্যুত্থানের আহ্বান জানান ফারাবী।
সেই স্ট্যাটাসে ফারাবী লেখেন, “আমি সেনাবাহিনীকে বলছি, আপনারা আর কতদিন অস্ত্র সাজগোজ করে রাখবেন। আপনাদের কি উচিত না এখন গণভবন আক্রমণ করে ড্রাকুলারূপী শেখ হাসিনার হাত থেকে দেশবাসীকে বাঁচানো।”
গত ২৩ ডিসেম্বরও একই রকমের একটি পোস্ট দেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হওয়ার গতবছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন ওই আন্দোলনের কর্মী ব্লগার রাজীব।
এরপর ফারাবী তার ফেইসবুকে এক স্ট্যাটাসে লেখেন- “যেই ইমাম থাবা বাবার (রাজীব) জানাজা পড়াবে, সেই ইমামকেও হত্যা করা হবে।”
একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট এলাকা থেকে ফারাবীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ফেইসবুক ব্যবহার করে ইমামকে হত্যার হুমকি দেয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গত জুন মাসে ফারাবীর বিরুদ্ধে ঢাকার একটি আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়।
হাই কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে গতবছরের ২১ অগাস্ট কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই একের পর এক ‘উগ্র’ স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক ছাত্র।