সরকারের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ তুলে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পরই আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
Published : 01 Mar 2014, 10:35 AM
দশম সংসদ নির্বাচনের পর রাজধানীর বাইরে প্রথম জনসভায় শনিবার তিনি এই ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, যতদিন এই সরকার থাকবে, জুলুম-নির্যাতনও চলতে থাকবে।
রাজবাড়ী জেলা শহরে শহীদ আব্দুল আজিজ খুশি রেলওয়ে ময়দানে এই জনসভায় বক্তব্যে তিন জঙ্গির পালানোর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দায়ী করেন।
বিএনপির কর্মী-সমর্থকে পূর্ণ এই জনসভায় জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা সুলতানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন খালেদার হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন।
ঢাকার বাইরে দীর্ঘ দিন পর খালেদার এই জনসভায় রাজবাড়ীর আশপাশের জেলাগুলো থেকে নেতা-কর্মী-সমর্থকরা যোগ দেন। স্থানীয় বিএনপির এই জনসভার মঞ্চে খালেদার সঙ্গে ১৯ দলের নেতারাও ছিলেন।
৪৫ মিনিটের বক্তব্যে খালেদা জিয়া বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে আন্দোলনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনের আগে দল গোছানোর কাজ সারার কথাও বলেন তিনি।
“আওয়ামী লীগকে বিদায় করতে হলে আন্দোলনের বিকল্প নেই। আমরা এখন দল গোছাচ্ছি। দল গুছিয়ে উপজেলা নির্বাচনের পরই আমরা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অতিদ্রুত নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করব।”
ওই আন্দোলনে সমর্থন চেয়ে সমাবেশের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “আন্দোলনের আবার ডাক দিলে আপনারা থাকবেন তো?”
সমাবেশে উপস্থিতরা সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলার পর তিনি বলেন, “এই আন্দোলনে আমরা সফল হব, আওয়ামী লীগও বিদায় হবে, দেশ রক্ষা পাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
নির্দলীয় সরকারের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ৫ জানুয়ারির ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা।
খালেদা দাবি করেন, সরকারের দমন-পীড়ন সত্ত্বেও জনগণ ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচন বর্জন করেছে।
“২৫ অক্টোবর থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এই তিন মাসের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ৩০৪ জন মানুষ হত্যা হয়েছে। গুম হয়ে ৬৫ জনের অধিক।”
“এই কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে এটি রক্তপিপাসু সরকার। আওয়ামী লীগ ভয়ঙ্কর জন্তুর চেয়েও খারাপ, তারা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। এদের না হটাতে পারলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব থাকবে না।”
যৌথবাহিনীর অভিযানের ‘নামে’ বিরোধী নেতাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩২ হাজার ‘মিথ্যা’ মামলা দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদ বিরোধী দলবিহীন বলেও দাবি করেন সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা।
সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টির সরকারে অংশ নেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, এই ধরনের নজির আর কোথাও নেই।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সরকারকে হুঁশিয়ার করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেই সঙ্গে জনগণকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
এই জনসভায় যোগ দিতে সকালে সড়ক পথে রওনা হয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওরে যাত্রাবিরতি দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখানে দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের কবর জিয়ারত করেন তিনি।
‘উপজেলায় গেছি বলে গা জ্বালা’
সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে দলের যুক্তি জনসভায় তুলে ধরেন খালেদা।
তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচন একটি স্থানীয় নির্বাচন। অন্যদিকে সংসদ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন, যাতে সরকার পরিবর্তন হয়।
“আমরা বলেছি, নির্দলীয় সরকার না হলে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেব না আমরা।”
চলমান উপজেলা নির্বাচনের ছয় পর্বের মধ্যে এই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত দুই পর্বে অধিকাংশ পদে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। আগামী মে মাস পর্যন্ত বাকি চার দফায় ভোট হবে।
খালেদার দাবি, ‘কারচুপি’ না হলে আরো বেশি পদে জয়ী হত বিরোধী প্রার্থীরা।
“উপজেলা নির্বাচনে কিভাবে ভোট কাটাকাটি ও কেন্দ্র দখল করেছে, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মানুষ তা জেনেছে। আমরা উপজেলায় গেছি, তাতেই তাদের (সরকারি দল) গায়ে জ্বালা ধরেছে।’’
“ছাত্রলীগ-যুবলীগ-গুণ্ডা বাহিনী এবং প্রশাসন যদি জোর করে ভোট কেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপারে সিল না মারত, তাহলে তারা কয়টিতে জয় পেত?”
মঞ্চে থাকা রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এম এ খালেককে দেখিয়ে খালেদা বলেন, “রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জ বেশি দূরে নয়, সেখানেও তারা দুটিতে হেরেছে। সেখানেও তাদের পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে।’’
‘দায় শেখ হাসিনারও’
ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশকে হত্যা করে প্রিজন ভ্যান থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দায়ী করেন সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা।
“তথাকথিত সরকারের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। তার সময়ে তিন জঙ্গি পালিয়েছে। এর দায় তাকেই নিতে হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।”
পলাতক জঙ্গিরা পুলিশের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে কথা বলতেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের দিকে ইঙ্গিত করে খালেদা বলেন, “আমাদের নেতাদের টেলিফোন কল রেকর্ড করা হয়। সিনিয়র নেতাদের এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে কঠিন পাহারায় কষ্ট দিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
“অথচ জঙ্গিরা না কি কারাগারে বসেই টেলিফোনে কথা বলে পালানোর পরিকল্পনা করল, তারা (সরকার) কিছুই জানলেন না!”
গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহ কারাগারে নেয়ার পথে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান আটকে গুলি-বোমা ছুড়ে ছিনিয়ে নেয়া হয় তিন জঙ্গিকে, পরে এদের একজন ধরা পড়েন এবং ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান।
জঙ্গি উত্থানের জন্য বিএনপিকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের জবাবে খালেদা বলেন, “বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সরকার জঙ্গি জঙ্গি শুরু করেছে। আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, এদেশে জঙ্গি ও আল কায়েদার কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে দেয়া হবে না।”
‘একতরফা’ নির্বাচন থেকে বিদেশিদের দৃষ্টি ফেরাতে এর আগে আওয়ামী লীগের ‘মদদেই’ সংখ্যালঘু নির্যাতন করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
জাপা নেতার যোগদান
জনসভার শেষ দিকে জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা সুলতানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন আহমেদ সদলবলে খালেদা জিয়ার হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন।
দুপুর আড়াইটায় জনসভা শুরু হলেও ঢাকা থেকে গিয়ে ডাক বাংলোয় মধ্যাহ্ন ভোজের পর বিকাল সোয়া ৪টায় জনসভাস্থলে পৌঁছান খালেদা।
জেলা বিএনপির সভাপতি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম এবং সদর উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এম এ খালেক দলীয় প্রধানকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ছাড়াও সমাবেশে বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সেলিমা রহমান, সাদেক হোসেন খোকা, ফজলুল হক মিলন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল, শিরিন সুলতানা, শাহ মো. আবু জাফর, শাহজাদা মিয়া, হেলেন জেরিন খান, নাসিরুল হক সাবু, শ্যামা ওবায়েদ প্রমুখ।
১৯ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ,জামায়াতে ইসলামীর মজিবুর রহমান ও আমিনুল ইসলাম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, ইসলামিক পার্টির আবদুল মোবিন, লেবার পার্টির মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, পিপলস লীগের গরীবে নেওয়াজ, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ,ডেমোক্রেটিক লীগের সাইফুদ্দিন মনি।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ, যুগ্ম সম্পাদক গাজী আহসান হাবিব, দপ্তর সম্পাদক এম এ মজিদ বিশ্বাস ও পৌর কমিটির সভাপতি মঞ্জুরুল আলম দুলালও বক্তব্য রাখেন জনসভায়।