রাজনৈতিক বিরোধের ফলে অব্যাহত সংঘাতে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতিতে উদ্বেগ জানিয়ে দুই প্রধান দলকে সংলাপে বসার জোর তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
Published : 03 Dec 2013, 11:28 PM
নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে মঙ্গলবার দিনভর সচিবালয়ে ড্যান মজীনার দফায় দফায় বৈঠকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক বিবৃতিতে সংলাপের তাগিদ দেয়।
সমঝোতার জন্য জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকোর আসন্ন সফরকে কাজে লাগানোর জন্যও বাংলাদেশের রাজনীতিকদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সহিংসতায় প্রাণহানি বন্ধে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার রাজধানীতে কর্মসূচি পালনের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদও দুই দলকে দ্রুত মতৈক্যে পৌঁছার আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে হরতালের পর অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল, যাতে সহিংসতায় প্রায় ৪০ জন নিহত হয়েছেন। অবরোধের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার পাশাপাশি অগ্নিদগ্ধের যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালেও আছেন অনেকে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের বর্জনের মধ্যেও তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
তাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টি থাকলেও মঙ্গলবার আকস্মিকভাবে দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দৃশ্যত ক্ষমতাসীন দলকে চাপে ফেলেছে।
এর মধ্যে সংলাপ হচ্ছে বলে সরকারি দলের নেতারা দাবি করে এলেও বিকালে এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তা নাকচ করেন।
নির্দলীয় সরকারের দাবির এই আন্দোলনের ‘চূড়ান্ত বিজয়’ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন ফখরুল; যদিও একদিন আগেই বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সমঝোতার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যকতার কথা জানিয়ে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, “সমঝোতার সময় কিন্তু স্লিপিং এ ওয়ে। সময় খুব কম।”
সমঝোতা হলে ঘোষিত তফসিলে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের মেয়াদপূর্তির সময় ঘনিয়ে আসায় প্রধান দুই দলের মধ্যে ‘গঠনমূলক সংলাপ’ অনুষ্ঠানের জন্য ‘নির্ভরযোগ্য’ কাউকে মধ্যস্ততার দায়িত্ব দেয়া আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে।
সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য দুই প্রধান দলের সদিচ্ছার প্রত্যাশা তাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ঢাকায় কানাডার রাষ্ট্রদূত হিদার ক্রুডেনও এক বিবৃতিতে বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে’ প্রধান দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমাধানে পৌঁছানোর সুযোগ এখনো রয়েছে বলে তার সরকার মনে করে।
সহিংসতা বন্ধে সরকার ইতোমধ্যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিরোধী দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে, মামলার আসামিও করা হয়েছে বিরোধী দলের মুখপাত্রকে।
সব রাজনৈতিক দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান জানালেও সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা, গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার ঘটনাগুলোকে অগ্রহণযোগ্য বলছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে সব মিলিয়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারেরই মূল দায়িত্ব বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা; আর এক্ষেত্রে বিরোধী দলের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এই বিবৃতির মধ্যেই দিনভর সচিবালয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় কাটান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা, কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করেন তিনি।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে বৈঠকের পর মজীনা বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ সফরকে চলমান অচলাবস্থা নিরসনের ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হতে পারে।
“এই সুযোগ কাজে লাগালে অর্থবহ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তারানকো ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় আসছেন বলে জাতিসংঘ দপ্তর নিশ্চিত করেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের একান্ত সচিব ফারহান হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চার দিনের সফরে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করার জন্য রাজনীতিকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলোচনা করবেন তারানকো।
গত মে মাসে ঢাকা সফরে এসে সংলাপের জন্য দুই প্রধান দলকে তাগিদ দিয়ে গিয়েছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিবের এই দূত। তবে তারপর দুই প্রধান নেত্রীর মধ্যে একবার টেলিফোনে আলাপ হলেও সমস্যার জট খোলেনি।
তারানকো আসার তিন দিনই আগে ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
এদিকে নির্বাচনে বিএনপি মনোনয়নপত্র জমা না দিলেও তথ্যমন্ত্রী ইনু রাষ্ট্রদূত মজীনাকে পাশে রেখে সাংবাদিকদের বলেছেন, “এখনো আমরা মনে করি, বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণে নির্বাচনটা করা দরকার। এখনো কিছু সময় আছে, যে সময়ের ভেতরে একটা অর্থবহ সংলাপ হতে পারে।”
তথ্যমন্ত্রীই কিছুদিন আগে বিরোধীদলীয় নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, নির্বাচনে না এলে ‘ট্রেন মিস’ করবেন।
সকাল ১১টার দিকে সচিবালয়ে ঢুকে বিকাল ৩টার পর বের হন মজীনা।। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মাদকের পাচার ও অপব্যবহাররোধে একটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি।
মজীনার সঙ্গে বৈঠকের পর তোফায়েল সাংবাদিকদের বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন দেখতে চাওয়ার কথা রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন।
কূটনীতিকদের এই উদ্যোগের মধ্যে শাহবাগে প্রতিবাদী এক কর্মসূচিতে রাজনীতিকদের প্রতি বিশেষ করে দুই প্রধান দলের আচরণে ক্ষোভ জানানো হয়।
সাম্প্রতিক সহিংসতায় অগ্নিদগ্ধ কয়েকজনের স্বজনও অংশ নেন কবি, শিল্পী, ছাত্র, শিক্ষকদের এই প্রতিবাদী কর্মসূচিতে।
বিরোধী দলের অবরোধে গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার জন্য সরকারি দল দুষে আসছে বিরোধী দলকে। অন্যদিকে বিরোধী দলের দাবি, এসব করছে সরকারের এজেন্টরা।
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সঙ্গীতশিল্পী কফিল আহমেদ আতঙ্কের এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চেয়ে বলেন, “আমরা জনগণ আগুনে জ্বলছি। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত এখন এক ভয়ঙ্কর খাঁচার ভেতরে যাচ্ছে।”