দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ভবন ধসের ঘটনায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ছয় শতাধিক।
Published : 24 Apr 2013, 03:20 PM
ভবন মালিককে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
ভবন মালিককে দায়ী করছে বিজিএমইএ
‘পুলিশের নিষেধ মানেনি গার্মেন্ট মালিকরা’
মঙ্গলবার ফাটল ধরার পর বুধবার সকালে ধসে পড়ে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকার নয় তলা ‘রানা প্লাজা’, যার চারটি তলায় পাঁচটি পোশাক কারখানায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করছিলেন ঘটনার সময়।
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেকেই আটকা পড়ে আছেন। কংক্রিট কেটে বের করে আনার আগে তাদের জন্য পানির বোতল আর অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সেনাবাহিনী, রেড ক্রিসেন্ট, পুলিশ, র্যাব সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিচ্ছেন।
তবে উদ্ধার কাজ পুরোপুরি শেষ হতে দুই-এক দিন লাগতে পারে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতাও আলাদাভাবে শোক জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার ভবনে ফাটল ধরার পর কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়া হলেও ‘নিষেধ উপেক্ষা’ করে গার্মেন্ট মালিকরা সকালে কারখানা চালু করেন বলে অভিযোগ করেছে শিল্প পুলিশ।
বিজিএমই কর্তৃপক্ষও বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি ‘বন্ধ’ রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও রানা প্লাজার মালিক স্থানীয় যুবলীগ নেতা সোহেল রানা তা রাখেননি।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, রানা প্লাজা নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারত বিধিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
বিজিএমইএ’র অতিরিক্ত সচিব হায়দার আলী রাত ১২টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১২০ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ৬৭টি লাশ তারা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা নিরূপণে বিজিএমইএ এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রানা প্লাজা ও অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনটি বুথ খুলেছে।
সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জনসংযোগ শাখার পরিচালক জাহিদুর রহমান জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত তাদের হাসপাতালেই ৯১ জনের লাশ এসেছে।
রাত সাড়ে ১০টায় ধ্বংসস্তূপ থেকে আরো পাঁচটি লাশ বের করে আনতে দেখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক।
এছাড়া স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সাভার ল্যাবএইড হাসপাতাল ও সাভার মডেল থানায় আরো অন্তত ১০ জনের লাশ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা।
ভবন থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয়জন এবং পঙ্গু হাসপাতালে আটজনকে পাঠানো হয়।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা অতিরিক্ত ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল ফজল মীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আশা (২৬) নামে একজন হাসপাতালে মারা যান।
পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল আউয়াল রিজভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের হাসপাতালে আনা আটজনের মধ্যে দুজনকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। বাকি ছয়জন শঙ্কামুক্ত।
এনাম মেডিকেল কলেজের পাশে অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সন্ধ্যায়ই লাশ হস্তান্তর শুরু হয়।
সাভার মডেল থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানান, বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নয়তলা ভবনটি পেছনের দিক থেকে হঠাৎ ধসে পড়তে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে মূল খুঁটি ও সামনের দেয়ালের অংশবিশেষ ছাড়া পুরো কাঠামোটিই ভেঙে পড়ে। এ সময় আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় দোকানদার সুজন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দোকানে বসেছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি ধুলার ঝড়ের মতো উঠল। আর চোখের পলকে বিল্ডিংটা ধসে পড়ল।”
ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার, প্রসাধন সামগ্রী ও কাপড়ের মাকের্ট এবং ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখা ছিল।
আর তৃতীয় তলার নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেড, চতুর্থ তলার ফ্যান্টম এ্যাপারেলস লিমিটেড, পঞ্চম তলার ফ্যান্টম ট্যাক লিমিটেড ও ষষ্ঠ তলার ইথার টেক্সটাইল লিমিটেডে প্রায় ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করতেন বলে স্থানীয়রা জানান।
ভবন ধসের পরপরই পুলিশ ও র্যাব্যের সঙ্গে উদ্ধার কাজে এগিয়ে যান স্থানীয়রা। এরপর ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা এলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে আটকে পড়াদের উদ্ধারে বেগ পেতে হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১০টি চিকিৎসক দলের পাশাপাশি রেডক্রিসেন্ট, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মীরাও ধসে পড়া ভবনের পাশে আহতদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দেন।
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক (জিওসি) মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী এবং স্থানীয় সাংসদ তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ দিনভর উদ্ধার কাজের তদারক করেন।
মেজর জেনারেল সোহরাওয়ার্দী বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, সর্বশেষ ব্যক্তি উদ্ধার না হওয়া তারা অভিযান চালিয়ে যাবেন। পুরো জায়গায় তল্লাসি চালানো হবে।
যারা আটকা পড়ে আছেন, তাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
“উপর থেকে গর্ত খুড়ে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আটকা পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা একটি সমন্বয় সভাও করেছেন বলে জানান মেজর জেনারেল সোহরাওয়ার্দী।
সকালে কারখানাগুলোতে কাজে আসা শ্রমিকদের স্বজন আর হাজারো জনতার ভিড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় ভবন ধসের পরপরই। ক্ষুব্ধ স্বজনদের ভিড় সামাল দিতে না পেরে এক পর্যায়ে রবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ।
এনাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফ্যান্টম ফ্যাশনের সুইং অপারেটর হেলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘটনার সময় তিনি চারতলায় কাজ করছিলেন। হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো ভবন দুলে উঠলে তিনি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে শুরু করেন। তারপর আর কিছুই তার মনে নেই।
সকাল ১০টার পর তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় উদ্ধারকর্মীরা।
হেলাল জানান, ভবনটি ধসে পড়ার সময় কারখানাগুলোতে পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছিলেন।
ভবনটিতে ফাটল ধরার পর মঙ্গলবার দুপুরে ভবনটি ঘুরে দেখেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
স্থানীয় প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক ভবনটি ঘুরে দেখে সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে বুয়েট থেকে প্রকৌশলী এনে ভবনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। তা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তবে ভবনটির মালিক পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সোহেল রানা সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “সামান্য একটু প্লাস্টার খুলে পড়েছে। এটা তেমন কিছু নয়।”
বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “ইমারত বিধিমালা অনুসরণ করে বিল্ডিং বানানো হয়নি। ঠিক উপাদানও এখানে ব্যবহার করা হয়নি। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে আমরা এটি উদঘাটন করব। দোষীদের আইনি ব্যবস্থায় আনব।”
রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলামও হতাহতের জন্য ভবন মালিককে দায়ী করেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “মঙ্গলবার ফাটল ধরার পরপরই বিজিএমইএর একটি পরিদর্শক দল শিল্প পুলিশের সঙ্গে ভবনটি ঘুরে দেখে। পরে ভবনের মালিককে বলা হয় যাতে বুয়েট থেকে বিশেষজ্ঞরা এসে পরীক্ষা করা পর্যন্ত ভবনটি বন্ধ রাখা হয়।”
ভবন মালিক সোহেল রানা পরিদর্শক দলকে ভবন বন্ধ রাখার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেও পরে তা তিনি মানেননি বলে উল্লেখ করেন আতিকুল ইসলাম।
হতাহতের এই ঘটনায় সোহেল রানাকে দায়ী করে তিনি বলেন, “তার সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য বিজিএমইএ সুপারিশ করবে।”
তবে সকালে কাজ শুরু করায় কারখানা মালিকদেরই দায়ী করেছে শিল্প পুলিশ।
শিল্প পুলিশের পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “গতকাল যখন ফাটল দেখা গেল তখনই শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যেন কারখানা বন্ধ রাখা হয়। আমরা বলেছিলাম, বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ার এসে পরীক্ষা করার পর কারখানা খোলা যাবে কি না জানানো হবে।
“কিন্তু শিল্প পুলিশের নির্দেশ উপেক্ষা করে মালিকদের একক সিদ্ধান্তে বুধবার সকালে তারা কারখানা খুলে দেয়।”
এর আগে স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে ঘটনাস্থলে উপস্থিত শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. ইস্রাফিল আলম বলেন, “কারখানা খোলার জন্য কে দায়ী এখনই এটা না দেখে আমাদের সবার উদ্ধার তৎপরতায় মনোযোগ দেয়া উচিত।”
পরে এ ঘটনার জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকও ঘটনাস্থলে যান।
পরে এনাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আহতদের খোঁজ খবর নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা এখানে এসেছি। তিনি আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। ঢাকা থেকে ১০টি মেডিকেল টিম এখানে এসেছে।”
আহতদের বিনা খরচে চিকিৎসা দেয়ারও ঘোষণা দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালেই এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক উদ্ধার তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দেন।
বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াও হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন এবং উদ্ধার কাজের সুবিধার জন্য বিরোধী দলের ৩৬ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহর করে নেয়া হয় নির্ধারিত সময়ের আগেই।
বিকালে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সাভারের ঘটনায় বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক পালন করা হবে। সব সরকারি-আধা সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
তিনি বলেন, “ধ্বংসস্তূপের ভেতরে অনেক আটকা পড়েছে। তাদের জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বড় বড় স্ল্যাবের নিচে অনেকে আটকা পড়েছে। তাদের উদ্ধারের জন্য ঢাকা থেকে সকল সরঞ্জাম পাঠানো হয়েছে।
উদ্ধার কাজ শেষ হতে দুই-এক দিন সময় লাগবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাব। আমরা সকলের দায়দায়িত্ব নিয়েছি। আমরা দেশবাসীর সহযোগিতা চাই।”
বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ইতিহাসে রানা প্লাজার ঘটনাতেই ভবন ধসে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
২০০৫ সালে সাভারের বাইপাইলে স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধসের ঘটনায় নিহত হন ৮৫ জন। আর পরের বছর একই ধরনের ঘটনায় তেজগাঁর ফিনিক্স গার্মেন্টে নিহত হন ২১ জন।