শহরের শাজাহানপুর থানা আক্রমণ ও ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড়ে র্যাবের গাড়িতে হামলার ঘটনায় সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন নয় জন। নিরাপত্তা দিতে থানায় উপস্থিত হয়েছেন সেনা সদস্যরা।
Published : 03 Mar 2013, 07:27 AM
জামায়াত-শিবির কর্মীদের জাঙ্গি মিছিল, বিভিন্ন স্থানে হামলা ও বিক্ষিপ্ত সংঘাতে সকাল থেকেই পুরো শহরে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পৌর এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
এদিকে বিকালে রেলপথ মেরামতে বাধা দেয়ায় মেরামতকারীরা কাজ না করে ফিরে গেছেন।
স্থানীয়রা জানান, ভোররাত ৩টার দিকে বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং করে জামায়াত-শিবির কর্মীদের জড় করা হয়। এরপর ভোর থেকে মিছিল নিয়ে শুরু হয় হামলা।
সদর থানার এস আই লুৎফর রহমান জানান, ভোর ৫টার পর জামায়াত-শিবির কর্মীদের কয়েকটি দল শহরের নারুলি, ফুলবাড়ী, স্টেডিয়াম ও মোকামতলা ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর শুরু করে। ব্যাপক হামলার মুখে এসব ফাঁড়ির দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা সরে যেতে বাধ্য হন।
এর পরপরই লাঠি হাতে মিছিল নিয়ে শাজাহানপুর থানায় হামলা চালায় জামায়াত-শিবিরের কয়েক শ’ কর্মী।
থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হামলা শুরু হলে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এ সময় ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হয়।
এই ঘটনার পর সেনা সদস্যরা থানার নিরাপত্তা দিতে ঘটনাস্থলে আসেন। বিকালে আবার তারা ফিরে যান বলে আতিউর রহমান জানান।
শাজাহানপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কার্যালয়েও ভাংচুর চালায় জামায়াত কর্মীরা।
থানা ও ফাঁড়িতে হামলার পরপরই শিবগঞ্জ, শাহজাহানপুর, বগুড়া জিরোপয়েন্ট সাত মাথাসহ বিভিন্ন এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জামায়াত-শিবির কর্মীদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু হয়।
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বগুড়া সদরের ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে র্যাবের গাড়িতে হামলা চালায় হরতাল সমর্থকেরা। র্যাব বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিতে নিহত হন অন্তত দুইজন।
ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে হামলার সময় করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার স্থানীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পৌর এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান সহকারী পুলিশ সুপার মকবুল হোসেন।
তিনি বলেন, “স্থানীয় প্রশাসন শহরে মাইকিং করে ১৪৪ ধারা জারি এবং সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করার কথা জানিয়ে দিচ্ছে।”
বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সিদ্দিক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ সাতজনের মৃতদেহ হাসাপাতালে আনা হয়েছে।
এদের মধ্যে শাজাহানপুর পশ্চিমপাড়ার মেহরাজের স্ত্রী আরজিনা (৪৫), দুমুন পুকুর গ্রামের তোতা মিয়ার স্ত্রী মর্জিনা (৪৮), রফিকউদ্দিনের ছেলে আব্দুর রহমান (৬০) ও মো. মুনসেরের স্ত্রী আছিয়া (৪৮) নিহত হন শাজাহানপুর থানায় হামলার ঘটনার সময়।
আর গাবতলী উপজেলার কলাকোপা এলাকার আলমগীর হোসেন (২২) এবং পালশাহ গ্রামের আব্দুল আলিমের ছেলে টিটু (২৪) গুলিবিদ্ধ হন ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে সংঘর্ষের ঘটনায়।
এছাড়া বাদল (৩৬) নামে আরেকজনের লাশ নিয়ে আসা হয় বগুড়া মেডিকেলে। স্বজনরা জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জয়পুর পাড়ায় সংঘর্ষের সময় বাদল মারা গেছে।
এছাড়া শিবগঞ্জ থানার ওসি ফজলুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, মোকামতলা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার সময় গুলিতে দুলু মিয়া (৪০) ও সাবু মিয়া (৪৫) নিহত হন।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরো ১৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে সিদ্দিক হোসেন জানান।
১৪৪ ধারার মধ্যেই সকালে শহরের কলিতলা এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজউদ্দিনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগ্নিসংযোগ করে হরতালকারীরা।
জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শাহরিয়ার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, জামায়াত শিবিরের কয়েকশ কর্মী স্লোগান দিতে দিতে এসে একতলা ওই বাড়িতে চড়াও হয়, তারা প্রথমে ভাংচুরের চেষ্টা করে এবং তারপর আগুন দিয়ে সরে যায়।
তবে আশেপাশের এলাকার লোকজন দ্রুত এগিয়ে এসে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
শহরের চকলোকমান এলাকায় বগুড়া- ১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের বাসায়ও হামলা ও ভাংচুরের চেষ্টা চলে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জানান।
সকাল ৮টার দিকে হামলা হয় বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে।
স্টেশন মাস্টার বেলাল হোসেন জানান, কয়েক শ’ লোক লাঠিসোটা নিয়ে স্টেশনে চড়াও হয় এবং ভাংচুর শুরু করে। তারা অফিসের কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয় এবং প্ল্যাটফর্মে আগুন দেয়।
তিনি বলেন, হারতালকারীরা সরকারি আজিজুল হক কলেজ ও শহরতালীর সাবগ্রাম এলাকায় রেল লাইন তুলে ফেলেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতে বগুড়া স্টেশন হয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
দুপচাচিরা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম জানান, জামায়াত-শিবির কর্মীরা উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পরে তারা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মিজানুর রহমানের বাড়িতেও হামলা করে।
এক পর্যায়ে জামায়াত-শিবির কর্মীরা থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে বলেও ওসি জানান।
নন্দিগ্রাম ইউএনও অফিসেও ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে জানান নন্দিগ্রাম থানার ওসি আমিনুর রহমান।
বেলা ১০টার পর শহরের গুদারপাড়া এলাকায় বগুড়া চেম্বার আয়োজিত বাণিজ্য মেলার স্টলেও হামলা চালিয়ে আগুন দেয় হরতালকারীরা।
এই মেলার ইজারাদার আব্দুল মতিন জানান, হামলাকারীরা মেলার স্টলগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে।
শহরের ঠনঠনিয়ায় বগুড়া ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সোহেল রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিভিন্ন স্থানে আগুন দেয়ার খবর পেয়েছি। কিন্তু হরতালকারীরা রাস্তায় বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে রাখায় আমাদের গাড়িগুলো ঠিকমতো পৌঁছাতে পারছে না। আমাদেরও নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে।”
সদর থানার উপ পরিদর্শক লুৎফর রহমান বলেন, “পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি সদস্যরাও মাঠে আছেন। আমরা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।”
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় আসার পর গত বৃহস্পতিবার সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় জামায়াত শিবির কর্মীরা। রায় প্রত্যাখ্যান করে রবি ও সোমবার সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার এই হরতাল ডাকা হয়।
বৃহস্পতিবার জামায়াতের সহিংসতার সময় গুলিতে হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবারও সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াতের প্রধান শরিক বিএনপি।
রেল পথ মেরামতে বাধা
বগুড়া রেল স্টেশন মাস্টার বেলাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিকাল ৫টায়
সরকারি আজিজুল হক কলেজ ও সাবগ্রাম এলাকায় জিআরপি পুলিশকে নিয়ে উপড়ে দেয়া রেলপথ মেরামত করতে গেলে একদল লোক বাধা দেয়। তাই তা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।