লালবাগের একটি চা দোকানে কাজ করেন আনোয়ার। আর সঞ্জয় কামরাঙ্গীর চরেরই একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক।
Published : 06 Feb 2013, 06:16 PM
বাড়ি কাছাকাছি এলাকায় হলেও তাদের উভয়ের পরিচয় শাহবাগের সমাবেশে, যেখানে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের দাবিতে চলছে হাজারো মানুষের অবস্থান।
বুধবার রাত সোয়া ১২টার দিকে সমাবেশস্থলে শতাধিক লোকের জন্য বিস্কুট, আপেল, পানি নিয়ে আসেন এক ব্যক্তি।
প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় বিস্কুটের প্যাকেট, আপেল, পানির বোতল সব কিছুই ছুড়ে দেয়া হচ্ছিল।
আনোয়ার একটি আপেল ও একটি পানির বোতল পান, সঞ্জয় পাননি।
সেই পানি আর আপেল যখন দুজন ভাগ করে খাচ্ছিলেন, তখনি তাদের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
রাতে না খাওয়া এই ‘দুই বন্ধু’ জানায় তাদের বন্ধুত্বের ইতিহাস।
দুপুরে আলাদাভাবে তারা চা খেতে যাওয়ার পর অন্য এক ব্যক্তি তাদের চায়ের বিল মিটিয়ে দেয়। সেখানেই কথা এবং বন্ধুত্ব।
“যুদ্ধের সময় যেমন সহযোদ্ধার ভিন্ন কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন হতো না। এখানে সবাই আমরা বন্ধু। কারো সঙ্গে কারো পরিচয় না থাকতে পারে কিন্তু আমরা সকলে সহযোদ্ধা।”
পাশেই ছিলেন খিলগাঁওয়ের স্কুলছাত্র আব্দুল হামিদ এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহ আলম।
শাহ আলম একটি বিস্কুটের প্যাকেট ধরতে পেরেছিলেন। সেটি খুলে তিনি বিস্কুট বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন সবার দিকে, নিচ্ছিলেন নিজেও।
আনোয়ারের সঙ্গে একমত শাহ আলমও- “একটি জাতি পতন বা উত্থান কখনোই একদিনে হয় না। দীর্ঘ দিনের নানা ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতায় এ জাতি পরাধীন হয়েছিল। এই জাতির স্বাধীনতার পথও সংক্ষিপ্ত নয়। ৭১’র সেই যুদ্ধ আজও চলছে।”
এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা মিলে সংগ্রাম করতে হবে, বলেন তিনি।
স্কুলছাত্র হামিদের সঙ্গে ছিলেন তার বাবা আব্দুল কাদেরও, যিনি এই সমাবেশে এসে স্মৃতিকারত হয়ে পড়েন।
“আমি ৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। জাহানারা ইমামের সঙ্গেও মিছিল করেছিলাম আমি।”
“আমার সৌভাগ্য যে আজ এমন একটি আন্দোলনে আমি আমার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পেরেছি।”
রাত ১টায়ও দিকেও কয়েক হাজার লোকের সমাবেশ ছিল শাহবাগজুড়ে। যেখানে শিশু-তরুণ-যুবক-বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষই রয়েছেন।
নানা বয়সী নারীদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। অনেকে এসেছেন সপরিবারে। সবার ঠিকানা এখন শাহবাগ।
আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের দাবিতে এই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যেতে প্রত্যয়ী আন্দোলনকারীরা।
যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার বিকাল থেকে যার শুরু, তার শেষ হবে শুধু রায় পুনবির্বেচনা হলেই- এটাই বলছেন তারা।
সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বুধবার রাতে শাহবাগে গেলে তাদের এই কথাই জানিয়ে দেয়া হয়।
মানিকগঞ্জ থেকে শাহবাগে ছুটে আসা ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম আদালতের রায়ের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, “আর কতগুলো খুন আর ধর্ষণ করলে তার (কাদের মোল্লা) ফাঁসি হবে- মহামান্য বিচারক বলুন।”
কর্মসূচির উদ্যোক্তারা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সমাবেশ এবং শুক্রবার মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন।
তাদের আহ্বানে দেশের এপ্রাপ্ত থেকে ওপ্রান্ত একই কর্মসূচি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
সমবেত কণ্ঠে স্লোগান চলছে, চলছে গান, কবিতা, সড়কে চিত্রাঙ্কণ, বক্তব্য- সব মিলিয়ে নতুন ধরনের এক আন্দোলন।
নতুন কর্মসূচির বিষয়ে এই সমাবেশের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের মাহমুদুর হক মুন্সি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শাহবাগে সমাবেশ করা হবে আর শুক্রবার হবে মহাসমাবেশ।
রায় পুনর্বিবেচনা এবং ফাঁসির আদেশ না আসা পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান চলবে বলেও জানান তিনি।
মঙ্গলবার রাতভর প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং কাদের মোল্লাকে ছয়বার প্রতীকী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের দাবি জানিয়ে নতুন দিন শুরু করে আন্দোলনকারীরা।
বুধবার সকালের আলো ফোটার পর জামায়াতের হরতালের মধ্যেও বিভিন্ন সংগঠন ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ দলে দলে শাহবাগের জনস্রোতে ভেসে পড়ে।
আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের চার দিকে চারটি সিগন্যাল পোস্ট যুদ্ধাপরাধীদের চারটি কুশপুতুল ঝুলিয়ে দেয়, মাঝখানে কাদের মোল্লার কুশপুতুল।
সকাল থেকে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সংসদ সদস্য ইসরাফিল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন, নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুসসহ অনেকেই সমাবেশে উপস্থিত হয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
শাহবাগের এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে সমবেত হচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. রফিকুল হাসান ছুটে আসেন গাজীপুর থেকে।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে এই শিক্ষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই রায় তরুণদের ব্যথিত করেছে। অচিরেই বাতিল করে সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই।”
শাহবাগে বিক্ষোভে যোগ দিতে চট্টগ্রাম থেকে মঙ্গলবার রাতের ট্রেনে ঢাকায় এসেছেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৌমিত্র শুভ্র।
এই মিছিলে শামিল হন যুক্তরাজ্য প্রবাসী নাফিসা শামসুদ্দিন, যিনি ‘অকুপাই ইউকের’ আন্দোলনে টানা আট মাস রাস্তায় ক্যাম্প করে থেকেছিলেন।
ঢাকাভিত্তিক একটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া ও ক্যাম্পেইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। প্রায় আট মাস আগে অসুস্থ দাদাকে দেখতে ঢাকা আসেন। এরপর থেকে বাংলাদেশেই অবস্থান করছেন।
একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ না হওয়ায় প্রতিবাদ জানাতে নাফিসাও যোগ দেন শাহবাগের আন্দোলনে।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সংহতি জানায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন সংহতি জানিয়ে বলেন, “এখনো আপিলের সুযোগ আছে। আদালতের মাধ্যমে অবিলম্বে এ সব যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন রায় প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “যে মানুষ এতগুলো মানুষকে হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, তাকে কেন ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।”