‘এক দাবি, ফাঁসি চাই’

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

সুলাইমান নিলয় আশিক হোসেন, সুজন মণ্ডল ও তানজির রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2013, 10:26 PM
Updated : 6 Feb 2013, 07:17 AM

রায় পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে ফাঁসির আদেশ না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর এ রায় প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার বিকালেই শাহবাগে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য ও ব্লগাররা।

রাতভর প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং কাদের মোল্লাকে ছয়বার প্রতীকী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের দাবি জানায় হাজারো তরুণ।

বুধবার সকালের আলো ফোটার পর তাদের এই আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। জামায়াতের হরতালের মধ্যেও বিভিন্ন সংগঠন ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষ দলে দলে শাহবাগের জমায়েতে যোগ দিয়ে সমবেত কণ্ঠে স্লোগান তোলেন- ‘যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই’।

আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের চার দিকে চারটি সিগন্যাল পোস্ট যুদ্ধাপরাধীদের চারটি কুশপুত্তলিকা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। মাঝখানে রয়েছে কাদের মোল্লার কুশপুত্তলিকা। এছাড়া সাপের আকৃতিতে বানানো হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের একটি কুশপুত্তলিকা। এরই মাঝে চলছে প্রতিবাদী গান, ফাঁসির দাবিতে শ্লোগান।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি  প্রমাণিত হওয়ার পরও কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। রায় ঘোষণার পরপরই আদালত চত্বরের আশপাশে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে তারা বিক্ষোভ করেন।

রাজাকারের হাতে স্বজন হারানো মানুষেরা হুঁশিয়ারি দেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে প্রয়োজনে আবারো মাঠে নামবেন তারা।

রাতে তাদের দাবি নিয়েই শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ শুরু করে ব্লগার ও ফেইসবুক অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় চেয়ে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি।

রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও শাহবাগে এসে ফাঁসির দাবিতে সংহতি জানান বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সকালে শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের মত অবস্থান। সকাল সাড়ে ৭টার পর থেকে নতুন করে লোকজন আসতে শুরু করে।

সকাল ৯টা নাগাদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এসে আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে। বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে সাধারণ মানুষ এসে সমবেত হয় শাহবাগ মোড়ে। গভীর রাতে সমাবেশস্থল থেকে চলে যাওয়া ব্লগার ও ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কসহ অন্য সংগঠনগুলোও এসে যোগ দেয় বিক্ষোভে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলও এ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে।

সকাল থেকে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সংসদ সদস্য ইসরাফিল ইহমেদ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার নূহ-উল-আলম লেনিন, নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস, নৃত্যশিল্পী দীপা খন্দকারসহ অনেকেই সমাবেশে উপস্থিত হয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রী বলেন, “কাদের মোল্লা যে অপরাধ করেছে তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে সরকার ও আওয়ামী লীগও হতাশ। এ থেকে প্রমাণিত হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছতা বজায় রেখে চলছে।”

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম সমাবেশস্থলে মাইকে বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।

শাহবাগে রাতভর বিক্ষোভে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত কাদের মোল্লাকে ছয়বার প্রতীকী ফাঁসি দেয়া হয়।

রাত ১টার দিকে শাহবাগ মোড়ের বিশ্ববিদ্যালয়গামী পথে পাকিস্তানোর পতাকা খচিত পোশাক পরা কাদের মোল্লার প্রথম ফাঁসি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র শিক্ষার্থীরা এই ফাঁসি দেয়।

এর আধা ঘণ্টা পর রাত দেড়টার দিকে কাঁটাবনগামী রাস্তায় দ্বিতীয়বার প্রতীকী ফাঁসিতে ঝোলানো হয় কাদের মোল্লাকে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে কাদের মোল্লার আরো চারটি কুশপুত্তলিকা এবং রাজাকারের প্রতীক হিসাবে একটি সাপ তৈরি করা হয়। কাঁটাবনগামী রাস্তায়‌ই তৃতীয় ফাঁসি হয় ভোর ৫টার দিকে। চতুর্থ ফাঁসি হয় বিশ্ববিদ্যালয়গামী সড়কের মুখে।

সোয়া ৫টার দিকের তার পঞ্চম প্রতীকী ফাঁসি হয় বারেডেমের সামনের সড়কে। আর ষষ্ঠবার প্রতীকী ফাঁসির রশিতে কাদের মোল্লারকে ঝোলানো হয় মৎস্যভবনমুখী রাস্তায় সকাল সাড়ে ৭টার দিকে।

প্রতীকী ফাঁসির সময় তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠে বার বার উচ্চারিত হয়- দড়ি ধরে দেব টান/ফাঁসি দিয়ে নেব জান, এমন রায় দিলো কে/কসাইটাকে ঝুলিয়ে দে, নিজামী-মুজাহিদ ভাই ভাই/এক রশিতে ফাঁসি চাই, জামায়াত-শিবির রাজাকার/রক্ত চোষা জানোয়ার, আমরা আছি থাকব/সুখে দুখে লড়বো- ইত্যাদি স্লোগান।

দ্বিতীয় প্রতীকী ফাঁসির উদ্যোক্তা ছিল নাটকের দল তীরন্দাজ।

আন্দোলনের প্রথম উদ্যোক্তা ব্লগার ও ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক রাত ১টার দিকে ওইদিনের মতো কর্মসূচি শেষ করে সকাল ৭টায় আবার শাহবাগে জড়ো হওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু অন্যরা সারা রাত থেকে বিক্ষোভের ঘোষণা দেয়।

এরপর কয়েকশ’ তরুণ-তরুণী স্লোগান-গান-আবৃত্তি করে রাত কাটিয়ে দেয়। দুটি বড় পর্দায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।

রাত আড়াইটার দিকে মুক্তির গান চলচ্চিত্র শেষ হয়ার পর বিজিবির দুটি গাড়ি শাহবাগের অবরোধের পাশ দিয়ে এগিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এ সময় সংবাদ মাধ্যম কর্মীরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা অস্বীকৃতি জানান। ভোর পৌনে ৫টার দিকে হঠাৎ একদল পুলিশ এসে বারডেমের পাশে সড়কে অবস্থান নেয়।

এ সময় বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সামনে গিয়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে।

ভোর ৬টার দিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে রাজাকারের মাথা দিয়ে সাপ তৈরি শেষ হয়। শাহবাগ মোড়ের কেন্দ্রস্থলে সেটিকে নেয়া হয়।

সমর্থনে ‘অকুপাই’ কর্মীরও

জামায়াত নেতা কাদেরে মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে হাজির হন যুক্তরাজ্য প্রবাসী নাফিসা শামসুদ্দিন। অকুপাই ইউকের এই কর্মী টানা আট মাস রাস্তায় ক্যাম্প করে মাঠে ছিলেন দাবি আদায়ের জন্য।

বর্তমানে ঢাকাভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার মিডিয়া ও ক্যাম্পেইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। প্রায় আট মাস আগে অসুস্থ দাদাকে দেখতে ঢাকা আসেন। এরপর থেকে বাংলাদেশেই অবস্থান করছেন।

একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ না হওয়ায় প্রতিবাদ জানাতে নাফিসা শামসুদ্দিনও যোগ দিয়েছেন শাহবাগের আন্দোলনে।