সৈয়দ নাহাস পাশা
লন্ডন থেকে
ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২৪ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- কাউন্সিলের তিন দিন আগে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেও আবদুল জলিল এখন মনে করছেন, ওই পদ ধরে রাখতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বিরোধে না জড়ানো ভুল ছিল। উপদেষ্টা পরিষদে রেখে শেখ হাসিনা অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার প্রতি 'অন্যায়' করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
দলের বর্তমান নেতৃত্বের সমালোচনা করে জলিল বলেন, বর্তমান মন্ত্রিসভার ৯০ শতাংশই 'সংস্কারপন্থী'। তবে এর আগে লন্ডনে বাঙালিদের টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্যই প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন।
সেনাসমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এক ধরনের সমঝোতা হয়েছিল বলেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দেন তিনি। তবে বাংলা টিভিকে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ও ক্ষমতারোহণের পেছনে সমঝোতা ছিল।
লন্ডনে বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জলিল বলেন, "তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশে ফিরে দলীয় পদ ধরে রাখার জন্য সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিরোধে যাওয়া উচিত ছিল। না যাওয়াটা আমার ভুল ছিল। তার প্রতি বেশি আনুগত্যই আমার অপরাধ।"
জরুরি অবস্থা জারির পর ২০০৭ সালের ২৮ মে জলিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৮ সালের ২ মার্চ প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান তিনি। ছয় মাস পর ৩১ আগস্ট দেশে ফেরেন।
এরপর অবৈধভাবে সম্পত্তি অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় ২০ অক্টোবর হাইকোর্ট জলিলকে জামিন দেয়।
জামিন পাওয়ার পর আদালত চত্বরে বসেই জলিল সাধারণ সম্পাদকের পদে দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিলে এ নিয়ে দলের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কারণ, গ্রেপ্তার অবস্থায় নিজের স্বাক্ষর করা একটি চিঠিতে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন জলিল। তখন দলে গণতন্ত্র নেই- অভিযোগ করে এর জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকেও দায়ী করেন তিনি।
কারামুক্তির পর জলিল চিঠির সব বক্তব্য অস্বীকার করেন। এরপর থেকে তাকে দলের পদে রাখা হলেও দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি।
এমনকি কাউন্সিলের কোনও কাজে তাকে যুক্ত করা হয়নি। ওই ক্ষোভ থেকে গত জুলাইয়ে জাতীয় কাউন্সিলের তিনদিন আগে পদত্যাগ করেন তিনি।
জলিল বর্তমানে সপরিবারে ব্যক্তিগত সফরে লন্ডন রয়েছেন। ল্যামবেথ এলাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম -এর কথা হয়।
জলিল বলেন, "আমি যে মুহূর্তে দেশে পদার্পণ করি (২০০৮ সালে) সে মুহূর্তেই নিয়ম অনুযায়ী দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব ফিরে পেলাম। জিল্লুর রহমান (তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এরপরই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা হুকুম দিলেন জিল্লুর রহমানকে। আমাকে বলা হলো, আপনি রেস্টে যান।"
জরুরি অবস্থায় গ্রেপ্তারের বিষয়ে জলিল বলেন, "আমি গ্রেপ্তার হওয়ার কারণ ছিল, ডিজিএফআই আমাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। কারণ, আমি তখন শেখ হাসিনার পক্ষে অহরহ বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। আর তখন আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব সংস্কারের জন্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা চালাচ্ছিলেন।
"ডিজিএফআইও চাচ্ছিল, আমি ওই লাইনেই কথা বলি। আমি বললাম, 'না'। শেখ হাসিনা আমার নেত্রী। যদি কোনও পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে তা করবে পার্টি; বাইরে থেকে নয়। ডিজিএফআইর নির্দেশে নয়। আমার অপরাধটি সেখানে। তারা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো। আমি তাদের কথা শুনিনি, সেটাই হলো আমার অপরাধ এবং তার জন্য আমি পুরস্কারের বদলে দল থেকে পেলাম শাস্তি।"
আওয়ামী লীগের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটিতে জলিলসহ দলের অনেক রথী-মহারথীদের ঠাঁই হয়নি। তার স্থান হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদে।
এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে জলিল বলেন, "উপদেষ্টা পরিষদে থেকে আমাদের কাজ করার কোনও অবকাশ নেই। শেখ হাসিনা তল্পীবাহকদের প্রেসিডিয়ামের সদস্য করে আমাদের প্রতি অন্যায় করেছেন।"
তার মতে, রাজনীতিতে তাদের নিষ্ক্রিয় করার চক্রান্ত হিসেবেই উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়েছে।
জলিল বলেন, "আমরা পাঁচটা মানুষ, যাদের ৫০-৫৫ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে, যারা এক্টিভিস্ট ছিলাম, যারা আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে শ্রম দিয়েছি, তাদের হঠাৎ করে আমলা-ব্যুরোক্র্যাটদের সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদে রাখা একটি আই ওয়াশ।
এটা বিচারের ভার আমি শেখ হাসিনার ওপর ছেড়ে দিতে চাই।"
মন্ত্রিসভা গড়তে এবার নতুনদের প্রাধান্য দিয়েছেন হাসিনা। যার ধারাবাহিকতা দলের কমিটিতেও দেখা গেছে।
প্রবীণদের 'উপেক্ষা'র সমালোচনা করে জলিল বলেন, "শেখ হাসিনা তার লক্ষ্য থেকে সরে গেছেন। এ দলটাকে ক্ষমতায় আনতে আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এখন দলের ইশতেহার বাস্তবায়ন হবে কার দ্বারা? ছেলে-ছোকরাদের দ্বারা? অনভিজ্ঞ মন্ত্রীদের দ্বারা?....সবই তো নতুন। এরা কী বোঝে?"
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়ে জলিল বলেন, "যদি তাই না হয়, তাহলে আমাকে সেক্রেটারির পদে দায়িত্ব পালন থেকে দুই বছর নিবৃত্ত রাখা হলো কেন? কেন এ দায়িত্ব সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দেওয়া হলে? এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং না হলে হতেই পারে না।"
জরুরি অবস্থায় জলিল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সৈয়দ আশরাফই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জলিলের মুক্তির পরও তাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলা হয়। জরুরি অবস্থায় বিভিন্ন নেতার ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা কাউন্সিলে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমা করলেও কিছু ভুলে যাবেন না।
আশরাফ ডিজিএফআই'র সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতেন অভিযোগ করে জলিল বলেন, "তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু তিনদিনের মাথায় তিনি আবার ফিরে এলেন কী সমঝোতায়? ডিজিএফআইর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে শেখ রেহানাই তাকে দেশে পাঠিয়েছিলেন।
"যে লোকটা সকাল-বিকাল ডিজিএফআই'র ভয়ে ধড়ফড় করত, তিনিই আবার দেশে ফিরে গেলেন! সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে ডিজিএফআই'র বোঝাপড়া করে দিয়েছেন শেখ রেহানা। তিনি প্রচ্ছন্নভাবে আওয়ামী লীগের কলকাঠি নাড়ছেন।"
সাবেক সাধারণ সম্পাদক জলিলের অভিযোগ, আত্মীয়তার সূত্রে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন আশরাফ।
তিনি বলেন, "সৈয়দ আশরাফকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে আত্মীয়তার সূত্রে। এ ছাড়া এর আর কোনও কারণ আমরা দেখি না। কাজ করার ব্যাপারে তার সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি সারা বাংলাদেশকে জানেন না। দেশকে চেনার অভিজ্ঞতাও তার নেই।"
মন্ত্রীদের সমালোচনা করে জলিল বলেন, "বর্তমান সরকারের ৯০ শতাংশ মন্ত্রীই সংস্কারপন্থী। সংস্কারপন্থীদের নিয়েই তিনি (হাসিনা) দল চালাচ্ছেন।"
সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সময় বিতর্কিত কয়েকটি বিষয় নিয়েও কথা বলেন জলিল। ২০০৪ সালে বিএনপিকে হটাতে 'ট্রাম্পকার্ড' এর কথা বলে শুধু নিজেই বিতর্কিত নন, দলকেও সমালোচনায় ফেলেছিলেন তিনি। এরপর কট্টরপন্থী ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
এ সব বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে জলিল বলেন, "ট্রাম্পকার্ডের বিষয়টি আমার একার নয়। আমার নেত্রীর এ বিষয়ে অনুমতি ছিল। তার অনুমতি ছাড়া আমি কিছু করিনি। এর প্রমাণ রয়েছে। ৩০ এপ্রিলের ঘটনা এবং উনার (হাসিনা) বক্তব্য নিয়ে যে সব নিউজ বেরিয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে আমি রিপোর্ট হাজির করব।
"পাঁচ দফা চুক্তির বিষয়ও বের করব। সেখানে আমি একা ছিলাম না। আমাকে ভিকটিম করা হয়েছে। ওই চুক্তির পেছনে শেখ হাসিনার অবদান ছিল। আমার দোষ হলো, আমি তার প্রতি খুব অনুগত ছিলাম। আনুগত্যই আমার অপরাধ।"
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী জলিল বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, "উনি কাজের চেয়ে কথা বেশি বলেন, এটা তার জন্য বিপজ্জনক। এ ছাড়া কার্যক্রমে যদি লোভ-লালসা পরিলক্ষিত হয়, তাহলে লক্ষ্য সফল হয় না। ফারুক সাহেবের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।"
সংসদে বিরোধী দলকে ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়ে সাংসদ জলিল বলেন, "আমি মনে করি, বিরোধী দলকে যে কোনভাবেই সংসদে নিয়ে আসা উচিত। তাদের সংসদে না আনলে সংসদ পূর্ণাঙ্গ হবে না। আমি এটা স্পিকারকেও বলেছি।"
আর কতদিন রাজনীতি করবেন- জানতে চাওয়া হলে জলিল বলেন, "যতদিন ঁেবচে থাকবো ততদিন জনগণের কথা বলব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করব।"
জলিলের মতো আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে ঠাঁই হয়নি আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্তেরও।
এতে দল সমস্যায় পড়বে কিনা- প্রশ্ন করা হলে জলিল বলেন, "কারও জন্যে কিছু আটকে থাকে না। কিন্তু তারপরও অভিজ্ঞতা ও দল চালানোর দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের থেকে দেশবাসী বঞ্চিত হবে। দল বঞ্চিত হবে।"
বাংলা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জলিল বলেন, "আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা এবং এ বিপুল বিজয়ের পেছনে একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে।"
বন্দি অবস্থায় শেখ হাসিনার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টিও এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।
বাংলা টিভি মঙ্গলবার রাত ১০টার (লন্ডন সময়) সংবাদে ওই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ প্রচার করে।
জলিলের সাক্ষাৎকারের বিষয়ে বাংলা টিভির চেয়ারম্যান ফিরোজ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাক্ষাৎকারটি জনতার মঞ্চ নামে একটি অনুষ্ঠানের জন্য ধারণ করা হয়েছে।
জলিলের সাক্ষাৎকারটি কবে প্রচার করা হবে- জানতে চাওয়া হলে ফিরোজ সুনির্দিষ্ট করে কোনও দিন-তারিখ বলেননি।
সাক্ষাৎকারটি প্রচার না করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ রয়েছে বলে বাংলা টিভির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান ফিরোজ খান।
আব্দুল জলিল ২০০২ সালের ডিসেম্বরে দলের ১৯-তম কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর আগে গত আওয়ামী লীগ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এসএনপি/এমআই/১৬০৫ ঘ.