অর্থ পাচার মামলায় ঢাকার গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা এনামুল হক এনু এবং তার ভাই রুপন ভূঁইয়াসহ ১১ জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
Published : 25 Apr 2022, 12:03 PM
ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেন সোমবার এই রায় ঘোষণা করেন। কারাদণ্ডের পাশাপাশি আসামিদের ৪ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন তিনি।
ঢাকার ক্রীড়াক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো বন্ধে অভিযানের মধ্যে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় দুই ভাই এনু ও রুপনকে। তার আগে তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় সিন্দুক ভর্তি কোটি কোটি টাকা আর সোনা, যা ক্যাসিনোর বাণিজ্যের ফসল বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
সে সময় অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ১২টি মামলা হয়। তার মধ্যে এই প্রথম কোনো মামলার রায় হল।
দণ্ডিত বাকি আসামিরা হলেন- মেরাজুল হক ভূঁইয়া শিপলু, রশিদুল হক ভূঁইয়া, সহিদুল হক ভূঁইয়া, জয় গোপাল সরকার, পাভেল রহমান, তুহিন মুন্সি, আবুল কালাম, নবীর হোসেন শিকদার ও সাইফুল ইসলাম।
আসামিদের মধ্যে শিপলু, রশিদুল, সহিদুল ও পাভেল মামলার শুরু থেকে পলাতক। এনু-রুপনসহ কারাগারে থাকা ৬ আসামিকে রায়ের সময় আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা তুহিনও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে বলা হয়, যারা কারাগারে আছে, তাদের সাত বছরের দণ্ড থেকে হাজতবাসের সময় বাদ যাবে। পলাতকদের সাজা কার্যকর হবে গ্রেপ্তারের দিন থেকে। দণ্ডিতদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হবে।
চার কোটি টাকা জরিমানার ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শওকত আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু কারোর ওপর নির্দিষ্ট করে ধরা হয় নাই, সেহেতু আমরা ধরে নেব, প্রত্যেকে সেটি সমানুপাতিক হারে জমা দেবেন।”
৪৬ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সংগঠিত অপরাধ ও অর্থ পাচার আইনের শাসনের জন্য এবং দেশের উন্নয়নের জন্য একটি বড় হুমকি ।
“দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ক্যাসিনোর জুয়া এবং ব্যবসা পেছনের দরজা দিয়ে নোংরা টাকার সরবরাহ করে সংগঠিত অপরাধ করে। এ প্রকারের অর্জিত অর্থ চাঁদবাজি, প্রতারণাকে ই উৎসাহিত করে। এখন থেকে যদি এ প্রকারের অবৈধ জুয়ার মাধ্যমে অর্থ অর্জনকে বাধা দেওয়া না যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। উন্নয়নের সকল উদ্যোগ ও কার্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দেশের বাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।”
বিচারক বলেন, “রাষ্ট্র এ ধরনের কাজকে প্রতিহত করার জন্য অপরাধে অংশগ্রহণকারীদের উপযুক্ত শাস্তি কামনা করে। সেজন্য উপযুক্ত শাস্তিই অপরাধীদের প্রাপ্য। প্রসিকিউশন অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। সে কারণে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হল।”
রায়ের প্রতিক্রিয়া
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শওকত আলম এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত সাজা কার্যকর করার ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “এ রায়ের পর ভবিষ্যতে এ ধরনের অপকর্ম নিরুৎসাহিত হবে। অপকর্মকারীরা ভয় পবে।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণ ও কাগজপত্র ভালোভাবে পযর্বেক্ষণ করে এ রায় ‘দেওয়া হয়নি’।
“দণ্ডিতরা উচ্চ আদালতে গেলে মহামান্য হাই কোর্ট লিগ্যাল এভিডেন্সেস পর্যালোচনা করে যথোপুযুক্ত আইনি প্রতিকার দেবেন বলে আমি মনে করি।“
এ আইনজীবী বলেন, “রায়ে যে পর্যবেক্ষণ বিচারিক আদালত দিয়েছেন, তার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু সেই অবজারভশনে যেসব তথ্য উপাত্ত আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে, আর যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ এসছে, তার সঙ্গে সাসটেইনেবল নয়। আমি আশা করি মহামান্য উচ্চ আদালতে গেলে এ রায়টি সেটঅ্যাসাইড হবে।”
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা এনু ও রুপন ভাই, তাদের এক কর্মচারী এবং তাদের এক বন্ধুর বাসায় অভিযান চালায় র্যাব।
সেই অভিযানে সিন্দুক ভর্তি নগদ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা, আট কেজি সোনা এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়, যেগুলো জুয়ার টাকায় গড়া সম্পদ বলে ওই সময় র্যাব জানিয়েছিল।
এর মধ্যে এনুর কর্মচারী আবুল কালাম আজাদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় দুই কোটি টাকা। এ ঘটনায় র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল হাসান ২৫ নভেম্বর ওয়ারী থানায় এ মামলা করেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, এনু ও রুপন দীর্ঘদিন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালিত হলে তারা তাদের অপকর্ম আড়াল করার জন্য কিছু অর্থ গোপন করার জন্য কালামের কাছে রেখেছিলেন। কালাম তা নিজের কাছে রাখেন, যা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের অপরাধ।
মামলাটি তদন্ত করে ২০২০ সালের ২১ জুলাই ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলী।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারক। মামলার বিচার চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষে ২০ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
গত ৬ এপ্রিল এ মামলার রায় ঘোষণার তারিখ রাখা হলেও বিচারক ছুটিতে থাকায় তা পিছিয়ে ২৫ এপ্রিল নতুন দিন রাখা হয়েছিল।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের শেয়ারহোল্ডার এনু গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং তার ভাই রুপন ভূঁইয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর দল থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়।
ক্যাসিনোবিরোধী সেই অভিযানে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন নেতার জুয়ার কারবারের খবর প্রকাশ্যে আসে।
এরপর ক্যাসিনোর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওই সময় ক্যাসিনো ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০টির বেশি মামলা করেছিল সংস্থাটি।