পুরান ঢাকার নারিন্দার গলি ঘরানার মূল সড়ক থেকে একটি গলিতে ঢুকে কিছু দূর এগিয়ে ডানে মোড় নিয়ে আরও সরু গলি ধরে এগিয়ে আবার ডানে মোড় নিয়ে তার চেয়ে সরু গলিতে ছয়তলা ভবন, তারই নিচতলার একটি কক্ষের পাঁচটি সিন্দুক খুলে পাওয়া গেছে ২৬ কোটি টাকা।
Published : 25 Feb 2020, 07:35 PM
লালমোহন সাহা স্ট্রিটে গেণ্ডারিয়া আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়ার এই বাড়ির কক্ষটি থেকে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর প্রায় এক কেজি ওজনের স্বর্ণালংকার ও বিভিন্ন দেশের মুদ্রাও উদ্ধার হয়েছে।
অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার একটি ভবন থেকে আরেক ভবনের দূরত্ব এক ফুটেরও কম। তুলনামূলক স্বল্প আয়ের মানুষেরই এখানে বসবাস। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াটিদের অধিকাংশই বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ও দোকানে কাজ করে থাকেন।
সময় টিভি থেকে নেওয়া ছবি
র্যাবের অভিযান শেষে মঙ্গলবার বিকালে যখন কয়েকজন দিনমজুর টাকার বস্তা মাথায় নিয়ে সরু গলি দিয়ে বের হচ্ছিলেন তখন অবাক হয়ে অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘এখানে এত টাকা ছিল!’
ছয় হাজার টাকা ভাড়ায় এই ভবনের পাশের ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে স্বামীর সঙ্গে থাকেন শেফালী বেগম।
তিনি বলছিলেন, “আমার এত কাছে এত টাকা ছিল!”
তার সঙ্গে থাকা অন্য নারীদেরও একই ধরনের কথা বলতে শোনা যায়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক দিন টিউশনিটা করছি, কিন্তু কখনও নিচতলার ওই দরজা খোলা দেখিনি।”
বিপরীত দিকের পারভীন ভিলার একজন বাসিন্দা বলেন, “কখনও নিচতলা খুলতে দেখিনি। আগে রাতে টুকটাক শব্দ পেতাম। দুই ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর কোনো শব্দ পেতাম না।”
নিচতলার যে ফ্ল্যাটে এই অভিযান চালানো হয় সেখানে ছোট দুটি কক্ষ এবং মাঝে একটি ডাইনিং রুম রয়েছে। ডাইনিং রুমে ছোট একটি খাট রয়েছে। বাথরুমে সাবান ও শেভ করার যন্ত্রপাতি দেখা যায়।
অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতগুলো টাকা যেহেতু রয়েছে রাতে কেউ না কেউ থাকত। সম্ভবত দুই ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পরে রাতে কেউ থাকত না।”
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পরিচালক এনু ছিলেন গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আর তার ভাই রুপন ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে ওয়ান্ডারার্সে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সরঞ্জাম, কয়েক লাখ টাকা ও মদ উদ্ধার করে র্যাব।
এর ধারাবাহিকতায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর গেণ্ডারিয়ায় প্রথমে এনু ও রুপনের বাড়িতে এবং পরে তাদের এক কর্মচারী এবং তাদের এক বন্ধুর বাসায় অভিযান চালিয়ে পাঁচটি সিন্দুকভর্তি প্রায় ৫ কোটি টাকা, আট কেজি সোনা এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, সিন্দুকে পাওয়া ওই টাকার উৎস ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো। টাকা রাখতে জায়গা বেশি লাগে বলে কিছু অংশ দিয়ে সোনা কিনে রাখতেন এনু।
ওই ঘটনার পর মোট সাতটি মামলা করা হয়, যার মধ্যে অবৈধ ক্যাসিনো ও জুয়া পরিচালনা ও অর্থ-পাচারের অভিযোগে চারটি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়া
সিআইডির ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ সে সময় বলেছিলেন, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো কারবারের হোতা ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এ দুই ভাই। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দুই ভাইয়ের নামে ২২টি বাড়ি ও জমি এবং পাঁচটি যানবাহনের সন্ধান পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
“জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, প্রথমে ওই ক্লাবে তারা 'ওয়ান টেন' নামে একটি জুয়া খেলা চালু করে, পরে নেপালিদের মাধ্যমে সরঞ্জাম এনে সেখানে পুরোদস্তর ক্যাসিনো চালু করে।”
দুই ভাইয়ের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৯১টি ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে প্রায় ১৯ কোটি ১১ লাখ টাকার তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে ইমতিয়াজ সেদিন বলেন, এসব ব্যাংক হিসাব এখন অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
এর মধ্যে তাদের এই বাড়ি থেকে এত টাকা উদ্ধার নিয়ে র্যাব-৩ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবিএম ফয়জুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এনু-রুপনের দুই ডজন বাড়ির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই বাসার সন্ধান পান তারা।
বদরুল নামে সেখানকার একজন প্রবীণ বাসিন্দা জানান, এক কাঠা জমির গড়ে তোলা ছয়তলা এই ভবনটি প্রায় নয়-দশ বছর আগে কিনেছিলেন এনু-রুপনরা।
কত টাকা দিয়ে তারা বাড়িটি কিনেছিলেন তা বলতে পারেননি তিনি। তবে এ এলাকায় এক কাঠা জমির দাম ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা বলে জানান বদরুল।
এনু-রুপনের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা মোট ১২টি বস্তায় ভরা হয়। কয়েকজন শ্রমিক টাকার বস্তাগুলো ওই বাড়ি থেকে মাথায় করে নিয়ে নারিন্দা প্রধান সড়কে রাখা র্যাবের ট্রাকে তোলেন।
টাকার বস্তা বয়ে আনার পর তার হাসি যেন থামছিলই না।
“জীবনে কখনও ভাবিনি এই ভাবে টাকার বস্তা বইব,” বলেন তিনি।