ঢাকায় দুর্নীতিবাজ-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযানের মধ্যে সিন্দুকে ভরে টাকার স্তূপ ও স্বর্ণালঙ্কার অন্য জায়গায় সরিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাই, তবে র্যাবের অভিযানে ধরা পড়ল ‘অবৈধ’ সেই পাঁচ কোটি টাকা।
Published : 25 Sep 2019, 12:49 AM
ঢাকার গেণ্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রূপন ভূঁইয়ার বাড়ি, তাদের এক কর্মচারী ও এক বন্ধুর বাসা থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার পাশাপাশি আট কেজি সোনা এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র্যাব।
সোমবার মধ্যরাতে গেণ্ডারিয়ার বানিয়ানগর মুরগিটোলায় তাদের ছয়তলা বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাব, যা চলে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত।
এরমধ্যে নারিন্দার লালমোহন সাহা স্ট্রিটে তাদের কর্মচারী আবুল কালামের বাড়ি এবং শরৎগুপ্ত রোডে সড়কে এনুর বন্ধু হারুন-অর-রশিদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে চার কোটি টাকা ও একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
বানিয়ানগর মুরগিটোলায় দয়ারগঞ্জ নতুন রাস্তার মোড়ে এনু ও রূপনের ছয়তলা বাড়িতে বসবাস শুরু হয়েছে ছয় মাস আগে।নতুন এই বাড়ির প্রথম তিনতলা রূপনের, পরের তিনটি এনুর। দামি আসবাবে ঘর সাজানো হলেও তারা কেউই এই বাসায় থাকেন না।
দুপুরে গেণ্ডারিয়ার বাসায় অভিযানের মধ্যেই লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মূল কলাপসিবল গেইট তালাবন্ধ। তবে বাড়ির নিচতলার প্রধান ফটক ও তার ভেতরের যতটা দেখা যায় তাতে জৌলুসের ছাপ স্পষ্ট। অনেক ডাকাডাকি করেও বাড়ির ভেতর থেকে কারও সাড়া মেলেনি।
এক পর্যায়ে কয়েকটি শিশু ছুটে জানায়, র্যাব সকালে এই বাসায় এসে একজন নারীসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। তবে র্যাবে পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্বীকার করা হয়নি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বাড়িটির নিচতলা, দোতালা ও তিনতলা রূপনের এবং চার, পাঁচ ও ছয়তলা এনুর। দোতালায় তিনি তার ছেলে তপু এবং ছেলের বউকে নিয়ে ভাড়া থাকেন।
চার ও ছয়তলার পুরোটাই ভাড়া আর পাঁচতলার তিন কক্ষের মধ্যে দুটি কক্ষ রেখে একটি কক্ষ ভাড়া দেওয়া। তিনতলাটা মনের মতো করে সাজিয়েছেন তার মেয়ে জ্যোতি।
গত শনিবার দুপুরে জ্যোতি (রূপনের স্ত্রী) এসে তার দোতালার বাসায় একটি সিন্দুক রেখে যায় বলে জানান সালেহা বেগম।
“র্যাব সোমবার রাত সাড়ে ১০টার পর অভিযান শুরু করে। মেয়ের রেখে যাওয়া সিন্দুক থেকে শুধু সোনা পায় তারা।”
সালেহার দাবি, তার ছেলে তপু ধোলাইখালে গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা করেন। এই ব্যবসার ১৭ লাখ টাকা আলমারিতে ছিল, ওই টাকাও নিয়ে গেছে র্যাব।
স্বর্ণালংকার সম্পর্কে তিনি বলেন, মেয়ের ১৩ বছরের বিবাহিত জীবনে বিভিন্নভাবে এসব স্বর্ণালংকার পেয়েছেন তিনি।
সালেহা বেগম বলেন, তার জামাতা রূপন রাজনীতি করেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এই পাঁচতলার একটি কক্ষে থাকেন আজমেরী বেগম নামের এক নারী। তিনি বলেন, মাসে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন কক্ষটি।
“অন্য দুটি কক্ষে দামি আসবাব থাকলেও এনু এখানে খুব কম আসেন। অধিকাংশ সময় দু্টি কক্ষে তালা লাগানো থাকে।”
র্যাব কর্মকর্তারা এনুর একাধিক স্ত্রী থাকার কথা জানালেও আজমেরী বলেন, তার একটাই স্ত্রী। তবে রূপনের দুই স্ত্রী রয়েছে।
এনু ও রূপন কোনো ব্যবসা বা চাকরি করেন বলে তার জানা নেই।
“শুধু জানি, তারা দুই ভাই রাজনীতি করে।”
এই বাড়িত তিন সিন্দুক খুলে নগদ এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, ৭৩০ ভরি সোনার গয়না পাওয়ার কথা জানায় র্যাব। পাশাপাশি দুইজনের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি পিস্তল, দুটি এয়ারগান ও একটি শটগান।
কালামের ঘরের সিন্দুকে টাকা আর টাকা
পুরান ঢাকার গলি-ঘুপচি পেরিয়ে লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ৮২/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে আবুল কালামের বাড়িতে যান র্যাব সদস্যরা।
একেবারে জরাজীর্ণ। দেয়ালে পলেস্তারাও নেই। সিড়িঁ দিয়ে এক সাথে দুইজন উঠা যায় না। দুটো ঘর। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন আবুল কালাম। তিনি জোহরের নামাজ পড়তে বাইরে যাওয়ার পরপরই বাসায় ঢোকে র্যাব।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এটা তাদের পৈত্রিক বাড়ি। ভাই-বোনরা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। তার ভাই আবুল কালাম ছোট চাকরি করেন। এলাকার এনুর সাথে থাকেন। কাজ করেন।
কালামের স্ত্রী শিলা রহমান বলেন, তার স্বামী এনুর কর্মচারী। এনুর কনস্ট্রাকশনের কাজ তদারকি করেন।
এনু ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের একজন কর্ণধার। ওই ক্লাবে কালাম যান কি না প্রশ্ন কা হলে শিলা বলেন, তার স্বামী কখনোই সেখানে যান না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীদের সামনে তালা ভেঙে ওই সিন্দুক থেকে এক হাজার টাকার নোটের দুই কোটি টাকা উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আকতারুজ্জামানও উপস্থিত ছিলেন।
টিভিতে অভিযান দেখেও সিন্দুক সরাননি হারুনের স্ত্রী
নারিন্দারই শরৎগুপ্ত রোডের ২২/১/এ নম্বর হোল্ডিংয়ে এনুর বন্ধু হারুন-অর-রশিদের বাড়ি থেকে আরেকটি সিন্দুক উদ্ধার করে তাতে দুই কোটি টাকা পেয়েছে র্যাব।
পুরান ঢাকার অলি-গলি পেরিয়ে এই বাড়ি এমন এক জায়গায় যেখানে সহজে চেনা খুব কষ্টকর। কোনো গাড়ি ঢোকে না। অভিযানের সময় র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ বুলবুলকে মূল রাস্তায় গাড়ি রেখে মটরসাইকেলে করে বেশ কিছু দূর গিয়ে আবার খানিকটা হাঁটতে হয়।
পাঁচ বছর আগে বাড়িটি কিনেছেন হারুন। দোতালা পুরানো এই বাড়ির সিঁড়িতে জায়গা হয় একজনেরই। হারুন ধোলাইখাল ট্রাক স্ট্যান্ড লেবার সমিতির সর্দার।
সিন্দুকটি শোয়ার ঘরের ওয়ারড্রোব আর আলমারির মাঝখানে রাখা ছিল। উপরে কাপড় দিয়ে এমনভাবে সেটি ঢাকা ছিল যে সেখানে সিন্দুক আছে বোঝার উপায় নেই।
লিপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আশপাশে যখন র্যাবের অভিযান চলছিল তখন টেলিভিশনে সেই খবর দেখেছিলেন তিনি। তখনও র্যাব তাদের বাসায় আসেনি।
“বেশ কয়েকজন র্যাব সদস্য বাসায় ঢুকে সিন্দুকের খবর জানতে চায়। তখন বলার আগেই তারা ঘরে ঢুকে সিন্দুক পেয়ে যায়।”
র্যাবের অভিযানের আগেই তার স্বামী বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন বলে জানান তিনি।
পরে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক ও ম্যাজিস্ট্রেট আকতারুজ্জানের উপস্থিতিতে সিন্দুকের তালা ভেঙে একইভাবে এক হাজার টাকার নোটের দুই কোটি টাকা পাওয়া যায়।
তার স্বামী এনুর বন্ধু জানিয়ে লিপি বলেন, “দুইজন লোক এসে এই সিন্দুক রেখে গেছেন।”
পরে র্যাব সদস্যরা লিপির মোবাইল দিয়ে হারুনের মোবাইলে ফোন করেন, তবে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সিন্দুকেই সূত্র?
গেন্ডারিয়ার বাড়ি এবং কালাম ও হারুনের বাড়িতে যে সিন্দুকগুলো পাওয়া গেছে সবই একই জায়গার, সিন্দুকের ওপর দোকানের নাম লেখা স্টিকার জ্বলজ্বল করছিল। সবগুলোই কেনা হয়েছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডের মালিটোলা বিপনী বিতানের শাবনাজ স্টিল কিং নামের একটি দোকান থেকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে শাহনাজ স্টিল কিংয়ের ম্যানেজার আবুল বাশার বলেন, দুজন লোক শনিবার সকালে দোকানে গিয়ে ৭৮ হাজার টাকায় ওই সিন্দুকগুলো কেনেন।
“তারা সিন্দুকগুলো দেখে দাম জিজ্ঞাসা করে এবং দাম বলার সাথে সাথে দরদাম না করে দ্রুত টাকা পরিশোধ করে দেয়। লেবারের জন্য সাড়ে চার হাজার টাকাও তখনই দিয়ে দেয়।”
“টাকা পরিশোধ করার পর দুজনের একজন আগে চলে যায়। অন্যজন লেবারদের সঙ্গে ভ্যানগাড়িতে সিন্দুকগুলো নিয়ে যায়।”
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল বাশার বলেন, একসঙ্গে পাঁচটি সিন্দুক কিনেছে, এ রকম আর কারও কথা তিনি মনে করতে পারেন না।
“র্যাবের দুজন সদস্য এসেছিল দোকানে। তারা ওই সিন্দুক কেনা নিয়ে কিছু তথ্য নিয়ে গেছে। তারপর সেই লেবারদের সঙ্গে নিয়ে গেছে বাসা চেনার জন্য।”
র্যাব কর্মকর্তা সফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, এনামুল হক এনুর ভাই রূপনের একসঙ্গে পাঁচটি সিন্দুক কেনার খবর পেয়েই দুই ভাইয়ের বিষয়ে খোঁজ শুরু করেন তারা।
“ক্যাসিনো থেকে আয়ের টাকা তিনি বাসায় সিন্দুক ভরে রাখতেন। রাখার জায়গা হত না বলে টাকার একটি অংশ তিনি সোনায় রূপান্তর করেছিলেন।”