একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা এলাকায় হত্যা ও ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সাবেক এমপি আব্দুল খালেক মণ্ডল এবং খান রোকনুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
Published : 24 Mar 2022, 10:47 AM
বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।
এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার এবং কে এম হাফিজুল আলম।
দুই আসামির মধ্যে আব্দুল খালেক মণ্ডল রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আর রোকনুজ্জামান মামলার শুরু থেকেই পলাতক। একাত্তরে খালেক মণ্ডল ছিলেন সাতক্ষীরায় রাজকার বাহিনীর সংগঠক, আর রোকনুজ্জামান ছিলেন ওই বাহিনীর সদস্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তারা সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় যেসব যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছেন, তা উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে।
দুই আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছিল প্রসিকিউশন। তার সবগুলোই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে জানিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ২০৮ পৃষ্ঠার এ রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান। তাতে খালেক ও রোকনুজ্জামান দুজনকেই তিনটি করে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
খালেক মণ্ডলের পক্ষে এ মামলা লড়েন আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার। আর পলাতক আসামি খান রোকনুজ্জামানের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন।
২০১৫ সালে এ মামলা হওয়ার পর ২০১৮ সালের ৫ মার্চ অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। সে সময় আসামি ছিল চারজন।
তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল বাকী এবং জহিরুল ইসলাম ওরফে টিক্কা খান নামের দুই আসামি বিচারাধীন অবস্থায় মারা যান।
বাকি দুই আসামির মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমির ও সাতক্ষীরা সদর আসনের সাবেক এমপি আব্দুল খালেক মণ্ডলকে তদন্তের সময়ই গ্রেপ্তার করা হয়। খান রোকনুজ্জামানকে পলাতক দেখিয়েই বিচার কাজ চলে।
গত বছরের ২১ নভেম্বর প্রসিকিউশন ও আসামিক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
প্রতিক্রিয়া
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন বলেন, “আমরা প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করছি, আমরা অনেক আনন্দিত।”
তদন্তকারী সংস্থা যুদ্ধপরাধের এই মামলার কাজ শুরু করে ২০১৫ সালের ১৬ মে থেকে। তদন্ত দায়িত্বে থাকা অন্যতম প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মামুন গত বছরের জুনে মারা যান।
এ রায়টি প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মামুন এবং একাত্তরের শহীদদের উৎসর্গ করে রেজিয়া সুলতানা চমন বলেন, “২০১৯ সালে এ মামলা শুরু করেছিলেন জেয়াদ আল মালুম স্যার, তিনি আজকের এই জাজমেন্টের ফসল দেখে যেতে পারেননি।”
রাষ্ট্রপক্ষ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আসামিপক্ষ বলেছে, তারা ন্যায় বিচার ‘পাননি’।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মতিউর রহমান আকন্দের দাবি, এ মামলায় ‘অসংখ্য অসঙ্গতির’ মধ্যে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সাবেক এমপি আব্দুল খালেক মণ্ডল এবং খান রোকনুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আব্দুল খালেক মণ্ডলের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে। এই আদেশের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। এখানে সাক্ষীদের জেরা, ডকুমেন্টস, মামলার বর্ণনায় অসংখ্য অসঙ্গতি রয়েছে। আমরা আশা করি আব্দুল খালেক মণ্ডল আপিলে খালাস পাবেন।”
আসামি বৃত্তান্ত আব্দুল খালেক মণ্ডল সাতক্ষীরার খলিলনগর ইউনিয়নের মৃত চান মণ্ডল ও দিলজান বিবির ছেলে, তার জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ অগাস্ট। খালেক মণ্ডল ১৯৬৫ সালে মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করে সাতক্ষীরা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৯ সালে বিএ পাস করেন। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে জড়িত খালেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ইসলামিক স্টাডিজেও এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রসিকিউশন বলছে, একাত্তরে তখনকার সাতক্ষীরা মহাকুমার রাজাকার বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন আব্দুল খালেক। তিনি সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ওই অঞ্চলের নিরস্ত্র বেসমারিক জনগণের ওপর নৃশংসতা চালান। সেই খালেক মণ্ডলই ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে সাতক্ষীরা-২ আসন থেকে এমপি হয়ে সংসদে গিয়েছিলেন। অপর আসামি খান রোকনুজ্জামানের জন্ম ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণ পলাশপুল গ্রামের মহব্বত আলী খান ও ওয়াহিদা খানমের ছেলে তিনি। এইচএসসি পড়ার সময়ই রোকনুজ্জামান ইমলামি ছাত্র সংঘের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা মহাকুমার রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে পরিচিত পান 'কুখ্যাত রাজাকার' হিসেবে। |
বিচার পরিক্রমা
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঁচ ব্যক্তিকে জবাই ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার অভিযোগে সাতক্ষীরা সদর আসনে জামায়াতের সাবেক সাংসদ আব্দুল খালেক মণ্ডলসহ নয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ২ জুলাই মামলা দায়ের হয়।
মামলা করেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শিমুলবাড়িয়া গ্রামের শহীদ রুস্তম আলী গাজীর ছেলে নজরুল ইসলাম গাজী; পরে মামলাটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
২০১৫ সালের ১৬ জুন ভোরে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খলিলনগর মহিলা মাদ্রাসায় বৈঠকের সময় জামায়াত নেতা খালেক মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সাতক্ষীরায় হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলার মধ্যে শহীদ মোস্তফা গাজী হত্যা মামলায় সাবেক এই জনপ্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে জানতে ২০১৫ সালের ৭ অগাস্ট তদন্তে নামে, যা চলে ২০১৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেক মণ্ডল, রোকনুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল বাকী এবং জহিরুল ইসলাম ওরফে টিক্কার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
সেখানে মোট ৩৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে ১৭ জনের সাক্ষ্য শুনে রায় দিল ট্রাইব্যুনাল।
কোন অভিযোগে কী সাজা
অভিযোগ ১: একাত্তরের ১৮ অগাস্ট বেতনা নদীর পাড়ে বুধহাটা খেয়াঘাটে আফতাবউদ্দিন ও সিরাজুল ইসলামকে রাজাকার কমান্ডার ইছাহাক (মৃত) ও তার সহযোগীরা গুলি করে হত্যা করে। পরে স্থানীয় খলিলুর রহমান, মো. ইমাম বারী, মো. মুজিবর রহমান ও ইমদাদুল হককে রাজাকার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ডায়মন্ড হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
এ অভিযোগে আব্দুল খালেক মণ্ডল এবং খান রোকনুজ্জামান দুজনকেই মত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
অভিযোগ ২: একাত্তরের পহেলা ভাদ্র ধুলিহর বাজার থেকে কমরউদ্দিন ঢালী নামের একজনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায় ১০/১২ জন রাজাকার সদস্য। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সাতক্ষীরা মহাকুমার রাজাকার কমান্ডার এম আব্দুল্লাহ আল বাকী ও খান রোকনুজ্জামান। পরে ঢালীর মৃতদেহ পাওয়া যায় বেতনা নদীর পাড়ে।
কমরউদ্দিন ঢালীকে হত্যার দায়ে কুখ্যাত রাজাকার রোকনুজামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
অভিযোগ-৩: ১৯৭১ সালের পহেলা ভাদ্র বুধবার বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল বাকী, রোকনুজ্জামান খানসহ ৪-৫ জন মিলে সবদার আলী সরদারকে চোখ বেঁধে পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। পরে আর তার সন্ধান মেলেনি।
সবদার আলী সরদারকে হত্যার দায়েও খান রোকনুজামানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এসেছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে।
অভিযোগ-৪: সোহেল উদ্দিন সানা নামের এক ব্যক্তি তার বড় ছেলে আব্দুল জলিল সানাকে সঙ্গে নিয়ে পহেলা ভাদ্র বুধহাটা বাজার অতিক্রম করার সময় রাজাকার কমান্ডার ইছাহাক (মৃত) ও তার সঙ্গী রাজাকারদের হাতে আটক হন। পরে তাদের ডায়মন্ড হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। সোহেল ও সানার সন্ধান আর মেলেনি।
দুই আসামির মৃত্যুতে প্রসিকিউশনের আবেদনে এ অভিযোগটি বিচারের মাঝামাঝি পর্যায়ে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালে ৭ আষাঢ় সকাল ৭টার দিকে আবুল হোসেন ও তার ভাই গোলাম হোসন নিজেদের বাড়ির পাশে হালচাষ করছিলেন। সকাল ৯টার দিকে গোলাম হোসেন বাড়িতে নাস্তা খেতে এলে আসামি আব্দুল খালেক মণ্ডল ও জহিরুল ইসলাম টিক্কা খানসহ ১০/১২ জন রাজাকার সদস্য এসে তাকে পাশের পাটক্ষেতে ধরে নিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে।
গোলাম হোসেনকে গুলি চালিয়ে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতের সাবেক এমপি আব্দুল খালেক মণ্ডলের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত।
অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ২ ভাদ্র সকালে বাশদহ বাজারের ওয়াপদা মোড় থেকে মো. বছির আহমেদকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর তার বুড়ো আঙ্গুলের রগ কেটে দেয় রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
মো. বছির আহমেদকে নির্যাতনের দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ এসে রাজাকার খান রোকনুজ্জামনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ-৭: ১৯৭১ সালের জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে আসামি আব্দুল খালেক মণ্ডল ও রাজাকার কমান্ডার জহিরুল ইসলাম টিক্কা খান একদল পাকিস্তানি সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে কাথণ্ডা প্রাইমারি স্কুলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের ডেকে মিটিং করে। সেই মিটিংয়ে বলা হয়, যারা আওয়ামী লীগ করে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তারা ‘কাফের’। এরপর তারা কাথণ্ডা ও বৈকারি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি-ঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয়।
সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই সদস্য মৃত গোলাম রহমানের স্ত্রী আমিরুনকে তার বাড়ির রান্নাঘরের পেছনে আটকে ধর্ষণ করে। এছাড়া বৈকারি গ্রামের ছফুরা খাতুনকে মৃত শরীয়তউল্লাহর ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে চার পাকিস্তানি সৈন্য।
জেলার কাথণ্ডা ও বৈকারি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, তাতে আগুন দেওয়া এবং ধর্ষণে যোগসাযশের দায়ে আব্দুল খালেক মণ্ডলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।