গন্তব্যে রওনা দিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর কিংবা কারও কারও বিকালও ছুঁয়েছে। চৈত্রের শুরুতে তেতে ওঠা রাস্তায় থেমে থেমে চলা আর অপেক্ষার ভোগান্তি ছাড়িয়ে গেছে অনেকের আগের অভিজ্ঞতা।
Published : 17 Mar 2022, 12:10 AM
বুধবার দিনভর যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী বলছে- রোজার আগের ব্যস্ততা আর মহামারীতে বন্ধ থাকা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরই সড়কে বেড়ে গেছে গাড়ির চাপ।
এদিন মহাখালী বাস টার্মিনালে আন্তঃজেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের কারণে বাস না চালিয়ে রেখে দেওয়া হয় সড়কের দুইপাশে। দূরপাল্লার এই টার্মিনাল ঘিরে ঢাকার অন্য সড়কগুলোতেও দেখা দেয় যানজট।
বুধবার বেলা ৩টার দিকে মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর আজমেরী গ্লোরি পরিবহনের একটি বাসের সহকারী আলমগীর হোসেন জানান, উত্তরা হাউজবিল্ডিং থেকে ১৭ কিলোমিটার পথ পেরুতে সময় লেগেছে সোয়া তিন ঘণ্টা।
এর আগে বেলা ১০টায় গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে যাত্রা শুরু করে বাসটি পৌনে ১২টার দিকে উত্তরা পৌঁছায়। আলমগীর বলেন, পুরো পথেই ছিল 'চরম যানজট'।
“১০টায় রওনা হইয়া এহন মাত্র মগবাজার। সদরঘাট যাইতে আরও কতক্ষণ লাগে জানি না। আইজ সারাদিন গেল রাস্তায় রাস্তায়, গাড়ি লইয়া চন্দ্রা ফেরত যাইতে কতক্ষণ লাগে বুঝতে পারতাছি না।”
দুপুরে মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ, শান্তিনগর,কাকরাইল এলাকার প্রধান সড়কেও ছিল তীব্র যানজট। দীর্ঘ সময় রাস্তায় আটকে থেকে চালকদের অনেকেই গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখেন।
বেলা সাড়ে ১২টায় মগবাজার থেকে কাকরাইল যেতে রিকশায় ওঠেন কলেজ শিক্ষার্থী ফারহানা রহমান। দেড়টায় মালিবাগ মোড়ে নেমে বাকি পথ হেঁটে যান তিনি।
ফারহানা বলেন, "আজকের মত যানজট গত কয়েক বছর ধরে দেখিনি। অসহ্য গরমের মধ্যে রাস্তায় বসে থাকতে হয়েছে। তারপর হাঁটতে গিয়ে ফুটপাতেও মানুষের ভিড় লেগে আছে।"
যানজটের সঙ্গে চৈত্রের শুরুতে গরমের আঁচও লেগেছে। ঢাকাসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মৃদু তাপপ্রবাহ বইছে এখন, ঢাকায়ই তাপমাত্রা উঠেছে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ফলে গরমের মধ্যে যানজটের কষ্ট আরও বেশি অনুভূত হয়।
মিরপুরের কালশী রোড-ইসিবি চত্বর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়কে সকাল থেকেই তীব্র যানজটের কারণে গরমের মধ্যেই অনেককে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হতে দেখা যায়।
বেসরকারি চাকরিজীবী হালিম সরকার জানান, সকাল ৯টায় অফিসের উদ্দেশে বের হন তিনি। যানজটের কারণে কালশী থেকে ইসিবি চত্বরে পৌঁছাতে ১ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
তিনি বলেন, "কালশীর দিকে রাস্তা চওড়া করা হয়েছে নতুন ফ্লাইওভার করার জন্য। কিন্তু ইসিবিতে এসে রাস্তাটা সরু হয়ে গেছে। অনেক গাড়ি একসাথে এসে ইসিবি ক্রস করতে গেলেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
“তবে এটা অফিস টাইমে বেশি। এতো ব্যস্ত রাস্তাতেও ট্রাফিক থাকে না। একে তো অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে যানজটের কারণে, আবার গরমে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে খুব।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় বেড়েছে গাড়ির চাপ
মহামারীর ধাক্কা সামলে দুই বছর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরোদমে পাঠদান শুরু হয়েছে মঙ্গলবার থেকে। শিক্ষার্থীদের বহনকারী যানবাহন বাড়ায় গত দুদিন ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যানজট দেখা গেছে।
বুধবার মোহাম্মদপুরের আসাদ অ্যাভিনিউ, তাজমহল রোডসহ আশপাশের সড়কগুলোয় সকাল থেকেই যানজট লেগে ছিল। যানজট ছিল মিরপুর রোডেও।
তাজমহল রোডের দোকানি ওসমান আলী বলেন, “স্কুল খোলার পর থেকে যানজট আগের চেয়ে বেশি শুরু হয়েছে। আর সামনে রোজার মাস, ঢাকার বাইরে থেকে অনেক লোক আসে। এসব কারণেই যানজট।”
আসাদ এভিনিউয়ে যানজটে বাসে বসে থাকা আজিজুল ইসলাম বলেন, “এই রাস্তার চারপাশে স্কুল। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো সব পার্ক করে রেখে দেয়। রাস্তা ছোট হয়ে আসে। যানজটতো হবেই।”
বুধবার সকালে কালশী থেকে বনানী, মহাখালী, নাবিস্কো হয়ে কাকরাইল যেতে সড়কেও তীব্র যানজট ছিল বলে জানিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফ হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে তিনি জানান, অন্যান্য দিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যে কালশী থেকে আমতলী যান। বুধবার ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট সময় লেগে গেছে।
“অন্যান্য দিন গড়ির চাপ থাকলেও এমন জ্যাম থাকে না। আমার মনে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরোদমে ক্লাস শুরু হওয়ায় গত দুই-তিন দিন ধরে এই যানজট বেড়েছে।”
কাকরাইলে কথা হয় ব্যক্তিগত গাড়ির চালক তমিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, গুলশান থেকে কাকরাইল আসতে আড়াইঘণ্টা সময় লেগেছে তার। মহাখালী, হাতিরঝিল, রামপুরায় পুরো সড়কেই ছিল যানজট।
তমিজ উদ্দিনের ভাষ্য, রাস্তায় প্রাইভেট কার, সিএনজি, দূরপাল্লার যানবাহন বিশেষ করে কভার্ড ভ্যান বেড়ে যাওয়ায় যানজট প্রকট হয়েছে।
“ঢাকা শহরে আমি ১২ বছর গাড়ি চালাই। যানজট এটা নতুন কিছু নয়। তবে গত কয়েকদিন আপনি লক্ষ্য করবেন, মহাখালী, হাতিরঝিল, রামপুরা, কাকরাইল, বিজয়নগর প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়েছে। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় মানুষজন এখন বেরুচ্ছেন বেশি, একইভাবে যানবাহনের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।”
গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর সবখানেই মানুষের উপস্থিতি বেশি বলে মনে করছেন পুরানা পল্টনে একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক মোল্লা জালাল উদ্দিন।
“স্কুল-কলেজ খুলেছে পুরোদমে। শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের নিয়ে বেরুচ্ছে। ফলে পরিবহনের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। যেটা গত সপ্তাহেও ছিল না।"
গুলিস্তান এলাকায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুল-কলেজ খোলায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রচুর গাড়ি বের হচ্ছে রাস্তায়। শহরে গাড়ি বেড়েছে। ফলে যানজট হচ্ছে।”
তবে যানজট সন্ধ্যার পরও ছিল বিভিন্ন সড়কে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মেরুল বাড্ডায় এক অগ্নিকাণ্ডের খবর পেলেও যানজটের কারণে সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি।
ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা রাশেদ বিন খালেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খবর পেয়ে বারিধারা থেকে দুটি ইউনিট রওয়ানা দেয় কিন্তু পথে গাড়ি যানজটে আটকা পড়েছিল প্রায় পৌণে এক ঘণ্টা।"
যানজটের কেন্দ্রে মহাখালী বাস টার্মিনাল
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান ঢাকায় অন্যান্য দিনের যানজটের সঙ্গে বুধবারের যানজটকে মেলাতে চান না।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মূলত ঢাকা জেলা বাস শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের কারণে বুধবার মহাখালী বাস টার্মিনাল কেন্দ্র করে রাজধানীতে ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয়।
“সকালে একদফা গাড়ি নিয়ে মহাখালীতে এসে ভোট দেয়। এসময় গাড়িগুলোকে বিভিন্ন গলিতে রেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়। পরে দুপুরের পর আরেক দফা ভোট দিতে আসলে যানচলাচলে বিঘ্ন ঘটে।”
মহাখালী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আইসিডিডিআর,বির সামনে থেকে বাস টার্মিনাল হয়ে তিব্বত বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে দূরপাল্লার বাস রেখে দেওয়া। যে কারণে অন্য যানবাহন চলাচলে বাধা পাচ্ছে।
জামালপুরগামী রাজিব পরিবহনের বাসের চালক ওসমান গণি জানান, শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের কারণে মহাখালী থেকে বেশিরভাগ বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এসব বাস রাখা হয়েছে সড়কে।
“ভিতরে এত গাড়ি রাখনের জায়গা নাই। তাই রাস্তায় রাখতে হইছে। কিছু গাড়ি তেজগাঁওয়ের বিভিন্ন সড়কে রাখন লাগছে। এই কারণে রাস্তায় কিছুটা চাপ পড়ছে।”
বাসগুলো রাস্তায় রাখা হল কেন জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্বাচনের কারণে গাড়ি চালাচ্ছে না পরিবহন শ্রমিকরা।
“নির্বাচনের জন্য তারা কেউ গাড়ি চালাচ্ছে না। রাস্তায় রেখে দিয়েছে। একটু পর সব গাড়ি চলে যাবে। গাড়ির কারণে রাস্তায় কিছুটা সমস্যা হয়েছে।”
তবে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী লুৎফুন্নাহার ফুরকান জানান, নিউ মার্কেটের সামনে থেকে মিরপুর ১১ নম্বরে পৌঁছতে অন্যান্য দিনের চেয়ে বুধবার তার দুই ঘণ্টা বেশি সময় লেগেছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “৪০ মিনিট ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করে হেঁটে নিউ মার্কেটে এসে একটা বাস পেয়েছি। পরে ৩৫ মিনিটেই আগারগাঁও চলে আসি। আর আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১১ নম্বরে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টার বেশি লেগেছে।
“এত সময় যদি রাস্তায় নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে অন্যান্য কাজ আমরা করব কীভাবে?“
তিনি জানান, নীলক্ষেত মোড়ে সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে যানজট সৃষ্টি হয়।
মেয়র চান কর্তৃত্ব
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম রাজধানীর যানজট নিরসনে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে নিজের কর্তৃত্বে চেয়েছেন।
তিনি বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “রাস্তা আমার, কতগুলো গাড়ি চলবে সেই ক্ষমতা আমার নাই। তা হলে কীভাবে হবে? রাস্তা আমার আন্ডারে, ট্রাফিক পুলিশ আমার আন্ডারে না, তাহলে তো হবে না।"
ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে এর আগে ওয়াসার খালগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন খাল উদ্ধারও করা হয়েছে, সেই উদাহরণ তিনি এ প্রসঙ্গে টানেন।
সেভাবে ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ ডিএনসিসির হাতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মেয়র আতিক বলেন, “খাল যেমন করে আমাদের হাতে দিয়েছেন, দেখেছেন এখন খালের কী অবস্থা। তেমনিভাবে ট্রাফিক দিবেন, যানজট আমরা কন্ট্রোলে আনতে পারব।”।
কীভাবে আনবেন- তার উত্তরে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে ডেকে অনুসন্ধান করে কোথায় কোথায় সমস্যা তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।