পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশনগুলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলেও নতুন কমিশনের প্রথম সংলাপে বিপরীত কথাই শুনতে হল নতুন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের।
Published : 13 Mar 2022, 09:35 PM
দায়িত্ব নেওয়ার পর ধারাবাহিক সংলাপের কর্মসূচি ঠিক করে রোববার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ঢাকায় নির্বাচন ভবনে মতবিনিময়ে ডেকেছিল ইসি।
তাতে অংশ নিয়ে ইভিএমকে ‘লো টেকনোলজি’র যন্ত্র বলেছেন লেখক-অধ্যাপক জাফর ইকবাল। অন্য কয়েকজনও ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত নেওয়ার পরামর্শ দেন।
ব্যালটে ভোট নেওয়ার পাশাপাশি যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবর্তন হয়েছিল ২০১০ সালে এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসির মাধ্যমে।
তখন বুয়েটের সহায়তায় ইভিএম তৈরি করে স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এরপর কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের ইসি ইভিএম নিয়ে বেশি এগোয়নি।
কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ইভিএম নিয়ে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সহায়তায় তৈরি করা হয় ‘ডিজিটাইজড ইভিএম’।
ইভিএমের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, এতে অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ভোটগ্রহণে সময় লাগে কম। এতে কারসাজির সুযোগ নেই বলেও দাবি করা হয় ইসির পক্ষ থেকে।
তবে ইভিএমে ভোটগ্রহণেও ফল বেশি আগে পাওয়ার নজির খুব বেশি দেখা যায়নি। ভোটারদের অনভ্যস্ততার কারণে ভোটগ্রহণে ধীরগতি দেখা গেছে। পাশাপাশি কারসাজির অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে।
রোববারের সংলাপে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, “এখানে বলা হচ্ছে ইভিএম একটা হাই টেকনোলজির ব্যাপার। এটা আসলে হাই টেকনোলজি নয়; এটা লো টেকনোলজি। আমাদের ইউনিভার্সিটির আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টরা এটা নিয়মিতভাবে করে থাকে।
“কাজেই নতুন নতুন টেকনোলজি এসেছে এখন। এটা ইন্ট্রিডিউস করা সম্ভব। ব্লক চেইন বলে একটা ব্যাপার রয়েছে, এটা করলে ফুলপ্রুভড হওয়া সম্ভব।”
ইভিএম বিষয়টি প্রযুক্তি সংক্রান্ত হওয়ায় সংলাপে আরও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অংশ নিলে ‘ভালো হত’ বলে মত জানান কম্পিউটার বিজ্ঞানের এই শিক্ষক।
সংলাপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার ইভিএম বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, “ইভিএম একটা হাইটেক মেশিন। এদেশের জনগণ প্রযুক্তি অচেতন, প্রযুক্তি জ্ঞান কম। এটা ব্যয়বহুল।”
ইভিএমে কারসাজির ঝুঁকির কথা তুলে তিনি বলেন, “এ মেশিনে কাগজের ব্যবহার নেই। হ্যাক প্রুভনেস প্রমাণ করুন। রেফারেন্ডাম করুন, মানুষ না চাইলে ইভিএম নয়। ঝুঁকি না নিয়ে ইভিএম বাদ দিন।”
ইভিএম নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির পরামর্শ দেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম মফিজুল ইসলাম।
ইসির উদ্দেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, “ইভিএম না কি ব্যালটে ভোট করবেন, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
‘গালি খেলেও ধৈর্য ধরতে হবে’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার যে লক্ষ্য নিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন ইসি কাজ শুরু করেছে, তাদের সবার আস্থা অর্জন করার উপর জোর দেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, আস্থার সঙ্কটে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোটার বিমুখিতাও রয়েছে। ‘ক্রান্তিকালে’ দায়িত্ব নিয়েছে এ কমিশন। বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, আস্থা অর্জন করতে হবে।
সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম মফিজুল ইসলাম বলেন, সব দল ও ভোটারকে নির্বাচনে নিয়ে আসাই চ্যালেঞ্জ।
আগামী নির্বাচন ‘অত্যন্ত ক্রুসিয়াল’ হবে বলে ইসিকে হুঁশিয়ার করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম।
তিনি বলেন, “যারা সমালোচনা করছে তাদের স্পেস দিতে হবে, কমিশনকে ধৈর্য ধরতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লায়লুফার ইয়াসমীন নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং ভোট কেন্দ্রে নিরাপদে আসার পরিবেশ নিশ্চিতে জোর দেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, সবার আস্থা অর্জনে কমিশনকে কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ কমিশন হিসেবে কাজ দেখাতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতার নতুন ইসিকে সতর্ক করেন যে দলীয় সরকারের অধীনে তাদের নির্বাচন করাটা সহজ হবে না।
তিনি বলেন, “এখন সরকারের কোর্টে বল। বিদ্যমান সিস্টেস্টে ভালো নির্বাচন সম্ভব না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন করা আপনাদের জন্য টাফ হবে। দলীয় সরকারের অধীনে অঘোষিত ডিকটেশন ছাড়া নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারে না। আপনারও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না।”
বর্তমান ইসির মূল্যায়নে এই শিক্ষক বলেন, “আপনাদের মধ্য তিনজন আমলা ছিলেন। সরকারের সুবিধাভোগী, চোখলজ্জারও ব্যাপার রয়েছে। আমরা সেভাবে দেখব।”
সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে পদত্যাগ করে চলে যেতে সাংবিধানিক সংস্থাটিতে দায়িত্ব নেওয়া ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান রাখেন অধ্যাপক ইয়াহহিয়া।
“প্রত্যেক জিনিসের একটা ওয়াক্ত আছে। ভোটের বাক্সেরও একটা খাবার সময় আছে, সেটা সকাল আট টা। কিন্তু লাস্ট ইলেকশনে কী হয়েছে, সে তো সেহেরি খেয়েছে। সে ব্রেকফাস্ট খায়নি। এমন নির্বাচন করলে তো হবে না।”
অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন বলেন, “ইসি থ্যাংকলেস জব, এটা মানতে চাই না।… ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আপনারা দেখিয়ে দেন ইসির ক্ষমতা।”
ইসি সদস্যদের সাহস দিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, “আপনারা যত যত্ন করেই কাজ করেন না কেন, আমি শিওর গালি খেতে হবে। লোকজন অনেক কিছু বলবেই। তবে দিন শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি আপনার বলতে পারেন আমি অনেস্ট ছিলাম, কাজটা সঠিক করেছি। তাহলে কে কী বলেছে, তা মাউন্ড করবেন না, তাহলেই হবে।”
আলোচনার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে মানুষে দুর্ভোগের কথাও তুলে ধরেন জাফর ইকবাল।
তিনি বলেন, “এনআইডি ভুল হয়ে গেলে শুনেছি ৫০ হাজার টাকা্ পর্যন্ত খরচ হয়। কীভাবে এটা হয়, জানি না। নতুন প্রোগ্রাম নেন এবং নাগরিকদের দুর্ভোগ কমাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন কমিশন এটা করলে পজিটিভ ইমেজ হবে।”
ইসি এই সংলাপে অন্তত ৩০ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। নানা কারণে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন না। বিকাল ৩টা থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী এই সংলাপ চলে।
‘সময়ই বলবে কতটুকু পেরেছি’
সংলাপে সবার বক্তব্য শুনে সিইসি বলেন, “আমন্ত্রিত অতিথিরা যে সব বক্তব্য দিয়েছেন তা শুনে গুরুত্বসহকারে নিয়ে লিপিবদ্ধ করেছি। পরবর্তীতে আলোচনা ও মূল্যায়ন করে কী করণীয় জানাব।”
অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক সমঝোতার উপর জোর দিলেও নিজেদের চেষ্টার কথাও বলেন তিনি।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, “এবসলিউটলি সব কিছু সম্ভব নাও হতে পারে। আমরা চেষ্টা করবো সামর্থ্য বাড়তে, আগামী নির্বাচনে দক্ষতাকে প্রয়োগ করে আরও সুন্দর, অবাধ করতে পারব। সবার সহযোগিতা লাগবে। উনারাও বলছেন, সমঝোতা লাগবে; সব দিক থেকে সহযোগিতা লাগবে।”
ইসির সংলাপে আমন্ত্রিতদের অর্ধেকই না আসার বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এটা নির্বাচন না। আমরা নিমন্ত্রণ করেছি। খুব স্বভাবতই অনেকের বিভিন্ন অসুবিধা থাকতে পারে। যারা এসেছেন ভালো আলোচনা হয়েছে, কোনো ঘাটতি হয় নি। মোটামুটি একই কথারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। আগামীতে আরও বেশি জনকে দাওয়াত করব।”
সংলাপের পরামর্শের পরও অতীতে কোনো কাজ না হওয়ার অসন্তোষ রয়েছে।
সিইসি বলেন, “অতীতেও দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন পরামর্শ। সময়ই বলে দেবেন কতটুকু করেছি, কতটুকু নিতে পেরেছি, তা ভবিষ্যত বলে দেবে।”
দলীয় সরকারের অধীনে ভালো ভোট না হওয়ার যে কথা এসেছে, সে বিষয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “সকলে এ ধরনের বলেননি। নির্দলীয় সরকার লাগবে। দুয়েকজন বলেছেন। কেউ বলেছেন, ওই নির্বাচনটা কেয়ারটেকার আমলে হয়েছে। এখন সাংবিধানিক সরকার আছে। এরমধ্যে নির্বাচন করতে হবে। দলীয় সরকার, নির্দলীয় সরকার-উনারা বক্তব্য দিয়েছেন, শুনেছি।”
কাজী রকিবউদ্দিন নেতৃত্বাধীন ইসির পরিচালনায় অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ দল অংশ নেয়নি। এরপর কে এম নূরুল হুদার ইসির সময়ে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দল এলেও ভোটের ফল নিয়ে তুলেছিল প্রশ্ন।
সেই দ্বন্দ্ব চলার মধ্যেই ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন হাবিবুল আউয়াল, যার নেতৃত্বে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন হবে।
সংলাপের শুরুতে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, “এ কমিশন নবগঠিত। কমিশনের কাজ হচ্ছে সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচন করা। বিভিন্ন সময় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন, নির্বাচনে পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন কারণে হয়ত হয়নি। ওই দিক থেকে সমালোচনা হয়েছে। এ জন্যে আমরা চাই, নির্বাচনটা যাতে আরও অধিক অংশগ্রহণমূলক হয়। প্রকৃত জনগণের মতামত রিফ্লেক্ট হয় থ্রু ব্যালট। এ জন্যে ইসির পক্ষ থেকে কী কী করণীয় বিদগ্ধজন হিসেবে আপনাদের মতামত নিয়ে আমরা ঋদ্ধ হব।”