হাফ ভাড়া: নারাজ বাস মালিকরা, বৈঠকেও আসেনি সিদ্ধান্ত

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরাল হয়ে উঠলেও বাসে হাফ ভাড়ার দাবি মানতে নারাজ পরিবহন মালিকরা। তারা বলছেন, সব শিক্ষার্থীর ভাড়া অর্ধেক নিতে গেলে তাদের বড় লোকসান গুণতে হবে।

ওবায়দুর মাসুমও তাবারুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Nov 2021, 06:43 PM
Updated : 25 Nov 2021, 06:43 PM

বাস মালিক নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, বেসরকারি পরিবহনে শিক্ষার্থীদের ভাড়া অর্ধেক নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর পরিবহন মালিকদের চাপে বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ালেও শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়ে পরিবহন মালিকদের চাপ দিতে অনীহ সরকার।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলছেন, বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার মতো না।

ডিজেলের দাম সরকার ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর বাস মালিকরা গাড়ি নামানো বন্ধ করে দিলে এই মাসের শুরুতে জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে।

এরপর বিআরটিএ পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ায়, যাকে বাস মালিকদের কাছে সরকারের নতি স্বীকার হিসেবে দেখছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতারা।

এরপর বাড়তি ভাড়া নিয়ে বাসে যাত্রী ও পরিবহনকর্মীদের মধ্যে বচসা চলার মধ্যে হাফ ভাড়ার পুরনো দাবি নিয়ে মাঠে নামে শিক্ষার্থীরা।

গত এক সপ্তাহ ধরে বিচ্ছিন্নভাবে তারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ-বিক্ষোভ করে আসছিল। বুধবার সড়কে সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সেই আন্দোলন বেগ পায়।

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনেও হাফ ভাড়ার দাবিটি ছিল। এখন সেই দাবিটি নতুন করে আসার পর তাতে রাজনৈতিকদের অনেকে এমনকি ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতাও তাতে সমর্থন দিয়েছেন।

এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সম্মেলনে সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবি নাকচ করেন।

সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ওই সম্মেলনে থেকে শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে পরিবহন মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তেমন সাড়া পাননি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সম্মেলনে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দুই পাশে মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ ও খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।

ওই সম্মেলনের পর বিআরটিএর উদ্যোগে সভা করলেও সেখানে পরিবহন মালিকদের শীর্ষনেতা সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ ও  মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ছিলেন না। তাদের একজন সংসদে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য, অন্যজন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা।

ঢাকায় ১০০টি বাস চালিয়ে আসা পরিস্থান পরিবহনের মালিকদের একজন মো. ওয়াজউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিলে তারা চলতে পারবেন না।

তিনি বলেন, “আমাদের গাড়িগুলো ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে করা হয়েছে। অধিকাংশ গাড়িই এখনও ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। নিজস্ব গাড়ি নেই বললেই চলে।

“এখন এক একটি গাড়িতে অন্তত ৫ থেকে ৭ জন স্টুডেন্ট উঠে থাকে। তাদেরকে যদি হাফ ভাড়া করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা তো ব্যাংক ঋণই পরিশোধ করতে পারব না।”

গত কয়েক বছরে গাড়ির যন্ত্রপাতির দাম বেড়ে যাওয়া, তেলের দাম বৃদ্ধি ও গাড়ি চলাচলে প্রতিদিনের ব্যয়ও বেড়ে যাওয়াকে কারণ দেখান তিনি।

ওয়াজিউদ্দিন বলেন, “আমাদের গাড়ি মালিকদের অনেকেই তিন বছর আগে লোন নিয়েছেন। এই লোনের সুদ ১৪ শতাংশ হারে দিতে হচ্ছে।”

তবে ডিজেলের দামের তুলনায় ভাড়া বেশি বাড়ানোর দিকটি নিয়ে কোনো কথা পরিবহন মালিকদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

এনায়েত বলেন, “বেসরকারি খাতে গাড়িতে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেওয়ার কোনো প্রভিশন নেই। সেটি বিআরটিসিতে আছে।”

বিক্ষোভে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা আমাদেরই ছেলে-মেয়ে। আমি মনে করি করোনাকালীন দীর্ঘ সময় তারা পড়ালেখা করতে পারেনি। তারা পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হবে, এটা আমাদের অনুরোধ থাকবে।”

“বেসরকারি খাতে শিক্ষার্থীদের থেকে হাফ ভাড়া নেওয়ার প্রভিশন কখনও ছিল না, এখনও নেই,” বলেন তিনি।

তবে এক সময়ের ছাত্রনেতা ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, পাকিস্তান আমলেও তারা গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, “দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছাত্ররা কনসেশন ভোগ করে থাকে। আমরাও পাকিস্তান আমলে যখন ছাত্র ছিলাম, এই কনসেশন পেয়েছি।”

শিক্ষার্থীদের দাবি সমর্থন করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকও বলেন, “১৯৬৯-৭০ সালে থেকে আমরা বাসে হাফ ভাড়া দাবি করেছিলাম। তখনকার প্রেক্ষাপটে দাবি অনুসারে ছাত্ররা অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার সুযোগ পায়। পরে স্বাধীন বাংলাদেশেও এভাবেই চলছিল।”

মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি বাস মালিকদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

দুপুরে মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর বিকালে বিআরটিএর উদ্যোগে বৈঠক হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগে এই বৈঠকে পরিবহন মালিক-শ্রমিক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়,পুলিশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসম্পাদক রাকেশ ঘোষ, মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল কালাম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ওসমান আলী উপস্থিত ছিলেন। তবে মালিকদের সংগঠনের শীর্ষ নেতারা কেউ ছিলেন না।

বৈঠক চলার সময়ই বিআরটিএর ভবনের নিচে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তারা বিআরটিএর ফটকে অবস্থান নিলে সভায় অংশ নিতে আসা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা আটকে যান।

পরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম এসে শিক্ষার্থীদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেন। সচিবের অনুরোধে মঙ্গলবার পর্যন্ত বিআরটিএকে সময় দিয়ে সেখান থেকে সরে যায় শিক্ষার্থীরা।

বৃহস্পতিবার বিআরটিএর ভবনের নিচে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।

বৈঠক শেষে সড়ক সচিব নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সরকারি পরিবহন বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ঘোষণা শুক্রবার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দেবেন।

তবে বেসরকারি বাসে শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি বলে তার কথা থেকে জানা যায়।

নজরুল বলেন, “হাফ ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায়, সে বিষয়ে মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, এই মুহূর্তে ৫০ শতাংশ ভাড়া কমানো হলে তাদের ভর্তুকি দিতে হবে।”

পরিবহন মালিকদের চাপ দিতে দৃশ্যত অনীহ সচিব বলেন, “বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার মতো না। এ কারণে বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসতে হয়।

“এখন যদি আমরা চাপিয়ে দিই, তারা যদি বলে আমরা গাড়ি চালাব না। তখন কিন্তু জনগণের আরেকটা ভোগান্তি তৈরি হবে। কাজেই আমরা চেয়েছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য।”

মালিক সমিতির কাছে অনুরোধ রেখেছেন জানিয়ে নজরুল বলেন, “তারা বিষয়টি নিয়ে বসবেন। কতটা ছাড় তারা দিতে পারেন বা এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য কী, তা আমাদের কাছে উপস্থাপন করবেন। আমরা বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব তারা যেন আমাদের কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।”