৩ দিন ভুগিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে চললো বাস-লঞ্চ

ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে সারা দেশে যে জনভোগান্তির সূচনা হয়েছিল, তিন দিন পর তার অবসান ঘটল বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2021, 03:52 PM
Updated : 7 Nov 2021, 04:24 PM

রোববার বিকালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং বাস মালিকদের সভায় বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানোর ওই সিদ্ধান্ত আসে। তারপর সন্ধ্যা থেকে ঢাকার টার্মিনালগুলোতে বাস ছাড়তে শুরু করে।  

রাতে নতুন ভাড়ার হার জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সোমবার থেকেই নতুন ভাড়া কার্যকর হবে।

ভাড়ার এই নতুন হার ডিজেলচালিত বাসের জন্য প্রযোজ্য জানিয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, “সিএনজিচালিতে বাসের ভাড়া এক পয়সাও বাড়ানো যাবে না, তাদের জন্য এই ভাড়া প্রযোজ্য নয়, আগের রেটে নেবে।”

ধরন

প্রতি কিলোমিটারে আগের ভাড়া

প্রতি কিলোমিটারে নতুন ভাড়া

প্রতি কিলোমিটারে বাড়ল

শতকরা বাড়ল

ন্যূনতম ভাড়া

দূরপাল্লার বাস ভাড়া

১ টাকা ৪২ পয়সা

১ টাকা ৮০ পয়সা

৩৮ পয়সা

২৬.৭৬%

-

মহানগরে বাস ভাড়া

১ টাকা ৭০ পয়সা

২ টাকা ১৫ পয়সা

৪৫ পয়সা

২৬.৪৭%

১০ টাকা

মহানগরে মিনিবাস ভাড়া

১ টাকা ৬০ পয়সা

২ টাকা ৫ পয়সা

৪৫ পয়সা

২৮.১২%

৮ টাকা

* ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলা) ভেতরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সার থেকে বেড়ে ২ টাকা ৫ পয়সা হবে।

ঢাকার সদরঘাটে শনিবার বিকালে শত শত যাত্রী এসে দেখেন, লঞ্চ চলছে না।

বাস মালিকদের পথ ধরে লঞ্চ মালিকরাও শনিবার থেকে থেকে ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে লঞ্চ মালিকদের বৈঠকে যাত্রীবাহী এই নৌযানের ভাড়াও ৩৫ শতাংশের বেশি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। 

মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়ে ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমদ বলেন, “এখন থেকে লঞ্চ চলাচল করবে। আজ থেকেই নতুন হারে ভাড়া নেওয়া হবে যাত্রীদের কাছ থেকে।”

দূরত্ব

প্রতি কিলোমিটারে আগের ভাড়া

প্রতি কিলোমিটারে নতুন ভাড়া

প্রতি কিলোমিটারে বাড়ল

শতকরা বাড়ল

ন্যূনতম ভাড়া

১০০ কিলোমিটার মধ্যে

১ টাকা ৭০ পয়সা

২ টাকা ৩০ পয়সা

৬০ পয়সা

৩৫.২৯%

৩০ টাকা

১০০ কিলোর বেশি

১ টাকা ৪০ পয়সা

২ টাকা

৬০ পয়সা

৪২.৮৫%

৩০ টাকা


বাসের সঙ্গে পণ্যবাহী বাহনের মালিকরাও গত শুক্রবার থেকে ধর্মঘট চালিয়ে আসছেন। রোববার বাস মালিকদের সঙ্গে বিআরটিএ এর বৈঠকে তারা যোগ দেননি। ধর্মঘট থেকেও সরে আসেননি। 

বাংলাদেশ ট্রাক, কভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরি প্রাইম মুভার মালিক শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের সদস্য সচিব তাজুল ইসলাম রোববার বিকালে বলেন, ‘ডিজেলের দাম না কমানো’ পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

ভোগান্তির তিন দিন

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে সরকার গত বুধবার রাতে ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। বৃহস্পতিবার প্রহর থেকেই সেই দাম কার্যকর করা হয়। 

পরদিনই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ধর্মঘটের ঘোষণা আসে। বলা হয়, ডিজেলের দাম না কমালে অথবা ভাড়া না বাড়ালে তাদের পক্ষে লোকসান দিয়ে রাস্তায় গাড়ি নামানো সম্ভব না।   

ধর্মঘটের কারণে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার অফিসগামীরা রিকশা-ভ্যানে চড়ে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ভাড়া বাড়ানোর একটি প্রস্তাব সেদিনই বিআরটিএতে পাঠানো হয় পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু বিআরটিএ ভাড়া পুনর্নির্ধারণের জন্য রোববার বৈঠকের দিন রাখলে তিন দিনের জনভোগান্তি অবধারিত হয়ে ওঠে।

পরিবহন মালিকদের ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার সকাল ৬টা থেকেই সারাদেশে বাস ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। রোববার সন্ধ্যায় ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা আসা পর্যন্ত তা চলে। 

শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন বলে মানুষের বের হওয়ার প্রয়োজন ছিল কম। কিন্তু যাদের জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হয়েছে, তাদের ভোগান্তির শেষ ছিল না। 

নানা প্রয়োজনে যাদের অন্য জেলায় যাওয়া প্রয়োজন ছিল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টার্মিনালে বসে থেকেও তারা বাস পাননি। অনেকে ভিড় করেছেন ট্রেন স্টেশন বা লঞ্চ ঘাটে। শনিবার লঞ্চ চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পরিবহন ধর্মঘট চলায় সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অফিস যেতে অনেকে পিকআপভ্যানেও চড়ে বসেন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

নগর-মহানগরে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষকে পথে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে বিপাকে। এ ধর্মঘটের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছে হাজারো শিক্ষার্থীকে। দুই দিনে দুই ডজন সরকারি দপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা থাকায় যানবাহন সঙ্কটের মধ্যে নাকাল হতে হয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীদেরও।

এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় বয়স্ক, নারী ও শিশুদের। রোগীদের নিয়ে যাদের হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে, তারাও রেহাই পাননি।

সপ্তাহের প্রথম দিন রোববার সেই ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। যানবাহন না পেয়ে পথে পথে নাকাল হতে হয় অফিসগামী যাত্রীদের।   

সাধারণ মানুষকে ‘জিম্মি করে’ এভাবে ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। সরকার কেন মানুষের ভোগান্তি এড়াতে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিল না, সেই প্রশ্নেও তোলেন কেউ কেউ। 

দীর্ঘ বৈঠক

বাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের জন্য বনানীর বিআরটিএ দপ্তরে বৈঠক শুরু হয় বেলা সাড়ে ১১টায়। ধর্মঘট এবং ভোগান্তি দুটোই তখনও চলছে।  

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ,  বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসাধারণ সম্পাদক রাকেশ ঘোষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন  শ্রমিক ফেডারেশনসহ সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধিরা ওই বৈঠকে অংশ নেন।

পরিবহন ধর্মঘটের তৃতীয় দিন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় অফিসগামীদের এই অপেক্ষা যানবাহনের জন্য। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার এই বৈঠক চলার মাঝে পরিবহন সমিতির নেতারা বিআরটিএতেই দুপুরের খাওয়া সারেন। সভাকক্ষের বাইরে গিয়ে কয়েক দফা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেও দেখা যায় তাদের।

এ সময় কয়েকবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর সঙ্গেও টেলিফোনে কথা বলেন পরিবহন মালিক এবং বিআরটিএর কর্মকর্তারা।

বৈঠক শেষে বাস মালিকদের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহকে সঙ্গ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার।

তিনি বলেন, বিআরটিএর ভাড়া পুনর্র্নিধারণ কমিটি ব্যয় বিশ্লেষণ করেছে। তবে কমিটির বিশ্লেষণে যে ভাড়া হয় তার, তুলনায় কম ভাড়া নির্ধারণ করেছে কমিটি।

“আমরা কয়েক দফা আলোচনা করেছি। ভাড়া বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট জনভোগান্তির কথা চিন্তা করে সর্বনিম্ন, যেটুকু না বাড়ালেই নয় সেটুকুই সর্বসম্মতভাবে বাড়ানো হয়েছে।”

রোববারের বৈঠকে পরিবহন মালিকদের পক্ষ মহানগরে বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ৪১ শতাংশ বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা এবং মিনিবাসে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়। আর দূরপাল্লার বাস ভাড়া ৪১ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা করার দাবি তোলেন পরিবহন মালিকরা।

অন্যদিকে বিআরটিএর পক্ষ থেকে বলা হয়, সবশেষ ব্যয় বিশ্লেষণ অনুযায়ী দূরপাল্লা ও মহানগরী এলাকায় ভাড়া হতে পারে যথাক্রমে ১ টাকা ৮২ পয়সা ও ২ টাকা ১০ পয়সা। তার সঙ্গে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির হার সমন্বয় করে বাস ভাড়া পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি আলোচনা হতে পারে।

ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে বাস ধর্মঘট; সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার বিকেলে ঢাকার ফার্মগেইটে বিআরটিসির বাসে উঠতে যাত্রীদের ভিড়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বৈঠক শেষে বাস ভাড়ার যে নতুন হার বিআরটিএ চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, তা আগের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ পরে সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৩ সালের পর বাসের ভাড়া আর বাড়ানো হয়নি। গত আট বছরে যন্ত্রপাতিসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। বেড়েছে তেলের দামও। সেই হিসাবে ভাড়া ‘খুব বেশি বাড়েনি’। তবে ‘জনগণের স্বার্থে’ তারা বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়াই মেনে নিচ্ছেন।

“আমি বাসের মালিকদের অনুরোধ করব, ধর্মঘট প্রত্যাহার করে যেন দেশে স্বাভাবিক অবস্থা হয়। যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। সব জেলা থেকে যেন বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়।”

“এর চেয়ে যেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা না হয়। আমার আহ্বান থাকবে এখন থেকে বাস ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হোক।”

পরে সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সন্ধ্যায় ভাড়া বাড়ানোর পর বিভিন্ন টার্মিনালে বাস এসেছে। চলাচলও শুরু করেছে।

পুরনো খবর