ঢাকার বেসরকারি কেয়ার হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর ১১ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যুর পর চিকিৎসকের গাফিলতি ও অবহেলার অভিযোগ এসেছে।
Published : 12 Oct 2021, 09:26 PM
এই মৃত্যুর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকার সিভিল সার্জন এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল-বিএমডিসিতে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন শিশুটির বাবা-মা।
হাসপাতাল ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি খতিয়ে দেখছে বিএমডিসি। অভিযোগ তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রায় এক মাস আগে তিন সদস্যের কমিটি করেছে।
তবে এ সংক্রান্ত কোনো অফিস আদেশ এখনও কমিটির প্রধানের কাছে পৌঁছেনি। ফলে থমকে আছে তদন্ত।
কেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অবশ্য গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তালু কাটার অস্ত্রোপচার করতে গত ২১ অগাস্ট কেয়ার হাসপাতালে ডা. বি কে দাসকে দেখানোর পর ভর্তি করা হয়েছিল মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল সায়েম ও মা তানজুম আক্তারের ছেলে আবদুল্লাহ আল আযানকে। ২২ অগাস্ট দুপুর সোয়া ১টায় শিশুটির অস্ত্রোপচার করা হয়। ওইদিনই রাত সাড়ে ১১টায় তার মৃত্যু হয়।
তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর গত ২৯ অগাস্ট বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), ঢাকার সিভিল সার্জন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে বিচার চেয়ে অভিযোগ দেন।
তাতে অদক্ষ লোকবল দিয়ে হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাব পরিচালনা, চিকিৎসকের গাফিলতিতে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া, অস্ত্রোপচারের পরে চিকিৎসকের অবহেলা, নার্সের ভুল নির্দেশনা, অস্ত্রোপচারের পর কর্তব্যরত চিকিৎসকের অনুপস্থিতি এবং ডেথ সার্টিফিকেটে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ২২ অগাস্ট দুপুরে অস্ত্রোপচারের পর পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছিল আযানকে। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করার পর থেকে আযানের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ওই সময় ওয়ার্ডে কোনো চিকিৎসক ছিল না।
শিশুটির বাবা-মা অভিযোগ করেন, হাসপাতাল থেকে যে মৃত্যু সনদ দেওয়া হয়েছে, তাতে মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে ‘অ্যাস্পিরেশন নিউমোনিয়া’। অর্থাৎ কিছু খাওয়ানোর সময় তা ফুসফুসে চলে যাওয়ায় ফলে সৃষ্ট নিউমোনিয়া। আর হাসপাতালে ভর্তির তারিখও ২১ তারিখের বদলে ২২ তারিখ লেখা হয়।
আবদুল্লাহ আল সায়েম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তারা ডেথ সার্টিফিকেটে ডিউটি ডাক্তারের নাম লিখেছে। কিন্তু সেদিন অপারেশনের পর থেকে আমার বাচ্চার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনো ডিউটি ডাক্তার সেখানে ছিল না।”
“আমার বাচ্চাকে আমি হয়ত আর ফিরে পাব না। কিন্তু যাদের অবহেলায় আমার বাচ্চা ‘খুন’ হয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যেন আর কোনো মা-বাবার বুক খালি না হয়,” বলেন তিনি।
তার অভিযোগ পেয়ে ৩১ অগাস্ট ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল হোসেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে পাঠিয়ে দেন।
বিএমডিসি গত ৮ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ডা. বি কে দাসকে চিঠি দিয়ে অভিযোগের বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চায়।
এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিএমডিসির কাছে লিখিত ব্যাখ্যায় অভিযোগ অস্বীকার করেন অধ্যাপক ডা. বি কে দাস (বিজয় কৃষ্ণ দাস)।
এ্ই চিকিৎসক বলেছেন, তিনি ওই শিশুর মৃত্যুর জন্য ‘অত্যন্ত দুঃখিত’। শিশুটির বাবার কাছে একাধিকবার ফোনে দুঃখও প্রকাশ করেন।
আযানের চিকিৎসায় কোনো অবহেলা করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, তার পেশাগত দক্ষতার সবটুকু দিয়েই চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
মৃত্যু সনদে ‘অ্যাস্পিরেশন নিউমোনিয়া’ লেখার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে ডা. বি কে দাস বলেন, “বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। কমিটির কাছে আমার বক্তব্য জানিয়েছি। এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।”
কেয়ার হাসপাতালের পরিচালক ডা. খান গোলাম মোর্শেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। কমিটি জবাব চেয়েছিল তাও দেওয়া হয়েছে।
“তারা (আযানের বাবা-মা) যে অভিযোগ করেছেন, তা ঠিক নয়। ডিউটি ডাক্তার, নার্স ছিল, রাত ১১টা পর্যন্ত কনসালটেন্ট নিজেও ছিলেন।”
বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. আরমান হোসেন মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে চিকিৎসককে চিঠি দিয়েছে বিএমডিসি। চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে অভিযোগকারীর কাছেও। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।
“আমরা অন্য একটা ইস্যু নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। সেকারণে ওই বিষয়ে অ্যাটেনশন দিতে পারছি না। ১৬ তারিখের (অক্টোবর) পরে জানানো যাবে।”
তিনি বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে বিএমডিসি।
“ডিসিপ্লিনারি কমিটি সুপারিশ করবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে পারে, তাকে তিরস্কার করতে পারে। আর হাসপাতালের অভিযোগের বিষয়ে আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সুপারিশ করতে পারি।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমুহ) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে আমাকে রিপোর্ট দিতে বলেছি। দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি না তা তদন্তে উঠে আসবে।”
চিঠি পাননি কমিটির প্রধান
অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করে দিতে গত ৬ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালককে চিঠি পাঠায়।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করে দেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান।
কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল ইসলাম এবং সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এস এম কামরুল আক্তার।
তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি পাননি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমান। তবে মৃত শিশুর অভিভাবক মোবাইল ফোনে কয়েকবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
“নিয়ম হলো ডিরেক্টর এনডোর্স করে আমাকে জানাবে। কিন্তু এমন কোনো চিঠিই আমার কাছে আসেই নাই। চিঠি না পেলে আমরা কাজ শুরু করব কীভাবে? কাল অফিসে গিয়ে খুঁজে দেখব।”