বিয়ের এক দশক পেরোলেও পরিবারের কেউ বুঝতে পারেনি ইভানা লায়লা চৌধুরী কতটা অসুখী।
Published : 20 Sep 2021, 12:16 AM
তার মৃত্যুর পর তার স্বজনরা জানতে পারল যে আইনজীবী স্বামীর সঙ্গে দুই সন্তান নিয়ে অসুখী এক দাম্পত্যে ছিলেন এই নারী।
তবে বন্ধুরা বলছেন, স্বামীর হাতে নির্যাতনের কথা ইভানা বলতেন তাদের, তবে বাবা-মার কথা ভেবে বিচ্ছেদের পথে এগোতে চাইতেন না।
ইভানার মৃত্যুর পর বন্ধুদের কাছ থেকে এসব শুনতে পেল তার পরিবারের সদস্যরা।
ইভানার বোন ফারহানা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৃত্যুর পর ইভানার বন্ধুরা বাসায় এসে অনেক কিছু জানিয়ে গেল। কিন্তু ইভানা আমাদের বরাবরই এরকম ধারণা দিয়ে গেছে যে ও খুব ভালো আছে। ওর সঙ্গে এত কিছু হয়েছে যে এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না।”
৩২ বছর বয়সী ইভানা রাজধানীর স্কলাসটিকা স্কুলের ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সেলর ছিলেন।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর বুধবার শাহবাগের পাশে পরীবাগের দুটি নয়তলা ভবনের মাঝ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ইভানার শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশকে জানানো হয়েছে, ইভানা ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে তাদের ধারণা।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া অপমৃত্যু মামলাটি তদন্ত করছে শাহবাগ থানা।
ইভানার স্বামী আব্দুল্লাহ হাসান মাহমুদ ওরফে রুম্মান একজন আইনজীবী।
২০১০ সালে তার সঙ্গে ইভানার বিয়ে হয়। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। দুই ছেলের মধ্যে একটির বয়স আট বছর, আরেকটি ছয় বছরের। ছোটটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক) শিশু।
শিশু দুটি এখন ইভানার বোন প্রকৌশলী ফারহানা চৌধুরী তিথির তত্ত্বাবধানে আছে।
ইভানার বাবা প্রকৌশলী আমান উল্লাহ চৌধুরী সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী। বিআরটিএর পরিচালক থাকা অবস্থায় তিনি অবসরে যান। তার তিন মেয়ের মধ্যে ইভানা সবার ছোট।
ফারহানা বলেন, “ছোট শিশুটি এখনও মাকে খুঁজছে, কিন্তু ও তো কথা বলতে পারে না। মায়ের অভাবে ওর অস্বাভাবিকতাগুলো আরও বাড়ছে।”
মৃত্যুর দুদিন আগে ইভানার সংসারে অসুখের আঁচ পেয়েছিলেন বলে জানান ফারহানা।
তিনি বলেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভিডিও কল করে খুব কান্নাকাটি করেছিলেন ইভানা। তখন তিনি বলছিলেন যে তার স্বামীর অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।
“ইভানা ডিভোর্স নিয়ে খুবই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। কারণ আমাদের পরিবারটা একটু পুরনো ধ্যান-ধারণার। আমার মা আমাদের শিখিয়েছেন বিয়ে সবচেয়ে বড় জিনিস, এটা আমরা টিকিয়ে রাখব। তবু্ও আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম আমরা দুই বোন আছি, বাবা-মা আছে। সবার সঙ্গে থাকবে ও। কিন্তু ও বারবারই বলছিল কেন ওর সঙ্গেই এরকম হবে?”
ফারহানা জানান, তার সত্তরোর্ধ্ব বাবা ও মা বনানীতে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন।
১৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে ইভানার শ্বশুর মোহাম্মদ ইসমাঈল ফোন করে তার বাবাকে জানান যে, তাদের ইভানা ও রুম্মনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি চলছে। বিষয়টি সুরাহার জন্য তিনি তাদের যেতে বলেন। তারা দুপুর ১২টার পর রওনা দেন। পরীবাগের ওই বাসায় গিয়ে তারা দেখেন ইভানা নেই। এরপর তিনিসহ সবাই মিলে দুই ভবনের মাঝে ইভানার লাশ পান।
ফারহানার অভিযোগ, ইভানার মৃত্যুর পর তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আচরণ ‘খুবই সন্দেহজনক’। তার স্বামী ব্যারিস্টার রুম্মান স্ত্রীর জানাজাতেও অংশ নেননি।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করে এবং বাসায় গিয়েও ব্যারিস্টার রুম্মানকে পাওয়া যায়নি।
তবে রুম্মানের বাবা সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইসমাইল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইভানা খুব ভালো মেয়ে ছিল। আমি তাকে স্নেহ করতাম। এখন রুম্মানের যে সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে সেটি তো আমি জানতাম না।”
সেদিনের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, “ওই দিন (বুধবার) তাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার পর আমি রুম্মানকে বাসা থেকে চলে যেতে বলে ইভানার বাবা-মাকে বাসায় আসতে বলি।
“তারা আসার আগে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ফোন কানে কথা বলতে বলতে ইভানা বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমরা ভেবেছিলাম ও বোধহয় নিচে যাচ্ছে।”
শ্বশুর ইসমাইলের ধারণা, বের হয়ে যাওয়ার পরপরই ইভানা নয়তলার ছাদে গিয়ে নিচে লাফ দিয়েছিলেন।
এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলো হয়েছে। থানার ওসি মওদুত হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিহতের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন তারা।
ইভানার পরিবার থেকে রোববার পর্যন্ত পুলিশকে কোনো অভিযোগ জানানো হয়নি বলে জানান তিনি।
ইভানার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি তার স্বজনরা- এমন অভিযোগের বিষয়ে ওসি বলেন, “উনার সঙ্গে (ব্যারিস্টার রুম্মান) আমাদেরও কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে তিনি পালিয়ে গেছেন, এমন কোনো তথ্যও আমাদের কাছে নেই।”
যা বলছেন শিক্ষক
“তালাকপ্রাপ্ত হিসেবে আমি আমার বাবা-মাকে দুঃখ দিতে চাই না। আমার বাচ্চারাও মনে হয় আমাকে ছাড়াই বাঁচতে পারবে। চিন্তা শুধু ছোট ছেলেটাকে নিয়ে। ও বিশেষ শিশু, ওর বিশেষ যত্ন প্রয়োজন।... অথচ আমার স্বামী আমার বাচ্চাদের বাবা আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন”- মৃত্যুর দুদিন আগে নিজের একজন শিক্ষককে এরকম এসএমএস পাঠিয়েছিলেন ইভানা।
পরিবারকে কিছু না জানালেও তালাক বিষয়ে পরামর্শের জন্য ইভানা যোগাযোগ করেছিলেন তার শিক্ষক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আসিফ বিন আনোয়ারের সঙ্গে।
ইভানা ২০১০ সালে ঢাকার কলাবাগানে অবস্থিত লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ থেকে এলএলবি করেন।
এই কলেজের শিক্ষক আসিফ বিন আনোয়ার বলেন, “কলেজে ইভানা ভালো বিতর্ক করত, পড়াশোনাতেও ভালো ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে বার এট ল সম্পন্ন না করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল।”
বিয়ের তিন বছর পর ২০১৩ সালের দিকে ইভানা তার সঙ্গে পারিবারিক সমস্যার বিষয়ে প্রথম যোগাযোগ করেন বলে আসিফ জানান।
তিনি বলেন, তখন ইভানা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলেও আসেননি। এভাবে ২০১৬ সালে একবার এবং ২০১৮ সালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও দেখা করতে আসেননি।
তবে ২০১৬ সালে দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের পর ইভানা তাকে বলেছিলেন, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেছে। না হলে তাকে তালাক দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
আসিফ বলেন, তালাক হওয়ার পর ভরণপোষণের আইন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন ইভানা।
এরপর আবার দীর্ঘ বিরতি। মৃত্যুর দুদিন আগে হঠাৎ আসিফের ই-মেইল ঠিকানা চান ইভানা।
আসিফ বলেন, তবে ই-মেইল না করে লম্বা এসএমএস বার্তা পাঠাতে থাকেন। আর তখনই দাম্পত্যে অসুখের কথা বলেন।
“তার স্বামী আরেক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এ কারণে ইভানা হাত কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলেও জানায়। আহত হাতের ছবি সে পাঠায়। আমি তাকে বলেছিলাম, বোকার মতো কিছু না করতে। ইভানাকে দ্রুত দেখা করতে বলেছিলাম, যাতে তাকে বিষয়গুলো
বুঝিয়ে বলতে পারি।”
ইভানা তার স্বামী ও তার বন্ধুর ‘এসএমএস চালাচালির’ কিছু স্ক্রিনশটও শিক্ষককে পাঠিয়েছিলেন।
সম্প্রতি ফেইসবুকের একটি পাবলিক গ্রুপে করা মন্তব্যে ইভানা লিখেছিলেন নিজের হতাশার কথা।
সেই সঙ্গে লিখেছিলেন, দ্বিতীয় শিশুটি অটিস্টিক হওয়ার কারণে তার স্বামীর হতাশার কথা।
“আমার দ্বিতীয় সন্তানটিও এএসডি (অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার)। কিন্তু ও যত বড় হচ্ছে, ওর চ্যালেঞ্জগুলো যত বাড়ছে, আমার ধৈর্য বাড়ছে আর ওর বাবার বাড়ছে হতাশা।”
স্বামীর সঙ্গে অন্য নারীর সম্পর্কের বিষয়টি তুলে নিজের অসহায়ত্বও প্রকাশ করেছেন ইভানা।
“যখন আমি এটা লিখছি তখন আমার জন্য নিঃশ্বাস নেওয়ায় কঠিন হয়ে উঠেছে। একা জীবনের জন্য আমি এখনো নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি। আমি এখনো আমার দুই সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত না। এবং আমাদের সমাজ সবসময় পুরুষদেরই পক্ষে থাকে ... আমার ছোট সন্তানটার কারণে নিজেকে শেষ করে দিতে পারছি না।”