অবসায়ন না করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডকে (পিএলএফএসএল) পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 28 Jun 2021, 02:43 PM
সেজন্য একটি কমিটিও করে দিয়েছে আদালত। ওই কমিটিতে কারা থাকছেন তা আদালতের লিখিত আদেশে থাকবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
পিএলএফএসএলের আমানতকারীদের আবেদনে সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক ভার্চুয়াল বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেয়।
পি কে হালদারের অর্থ কেলেঙ্কারিতে গাড্ডায় পড়া পিপলস লিজিং পুনর্গঠন বা পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশনা চেয়ে গত সপ্তাহে ২০১ জন আমানতকারী আইনজীবী শামীম আহমেদ মেহেদীর মাধ্যমে এ আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, আইন অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের কোনো বিধান নাই। তবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের একটি পরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংক নিতে পারে।
পিএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলে আমানতকারীদের ‘ক্ষতির বোঝা আরও বাড়বে’ বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম। আর পিএলএফএসএলের সাময়িক অবসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুইডেটর) মো. আসাদুজ্জামানের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মেজবাহুর রহমান।
আইনজীবী আহসানুল করিম পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালত পিপলস লিজিংকে অবসায়ন না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। একে পুনরুজ্জীবীত করতে একটি বোর্ড গঠন করে দেবেন। সে বোর্ড কার নেতৃত্বে হবে, কে কে থাকবেন তা পরে জানানো হবে। লিখিত আদেশ এক সপ্তাদের মধ্যে পাব।”
অবসায়কের আইনজীবী মেজবাহুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৌখিক আদেশে আদালত বলেছে যে, পিপলস লিজিং এখন অবসায়ন থেকে পুনরুজ্জীবীত হল। অবসায়ন হবে না। আদালত একটি বোর্ড করে দেবেন চেয়ারম্যানকে প্রধান করে। সেই বোর্ড চার-পাঁচজন থাকবেন যারা পিপলস লিজিংটা চালাবেন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।
“সেই নির্দিষ্ট সময় কতদিনের তা এখনই বলা যাচ্ছে না। নতুন কোনো বিনিয়োগকারী যদি প্রতিষ্ঠানটি কেনার প্রস্তাব দেয় বা সরকার যদি কিছু করতে বলে, তবে বোর্ড সেটা দেখবে।”
বাংলাদেশের ব্যাংকের আইনজীবী তানজীব উল আলম শুনানিতে বলেন, কোম্পানি আইনে মামলাটি চলছে। কিন্তু আমানতকারীরা আবেদন করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের আলোকে। সে হিসাবে আমানতকারীরা পিপলস লিজিং পুনরুজ্জীবীত বা পুনর্গঠনের যে আবেদনটি করেছেন, তার ‘এখতিয়ার’ নেই।
আমানতকারীদের আইনজীবী আহসানুল করিম বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, আমানতকারীরা এ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে।
“বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানকে মিটিং করেছিলাম। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অভিমত দিয়েছিলেন পিপলস লিজিংকে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে। রিভাইব করতে লজ্জার কিছু নাই।”
পরে বিচারক তার আদেশে বলেন, এই বোর্ডে চেয়ারম্যান হবেন হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি অথবা একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। আর বোর্ডে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, একজন আইনজ্ঞ, একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও আমানতকারীদের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি থাকবেন।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। ওই চার কোম্পানির মধ্যে পিপলস লিজিংও একটি।
পরে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাট করে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান বলে ২০২০ সালের শুরুতে খবর আসে। তাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি করা হয় রেড নোটিস।
১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপিই ৭৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হার ৬৬ শতাংশ।
২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান দেয় ওই কোম্পানি। খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আদায় করতে না পারায় আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারেনি তারা।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিনই মামলার শুনানি শেষে অবসায়নের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।
এছাড়া অবসায়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজনকে অবসায়ক নিয়োগ দিতে বলা হয়।
পরে সাময়িক অবসায়ক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান খানকে নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে আমনতকারীরা আদালতের দারস্থ হলে পিএলএফএসএল থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, এমন ২৮৬ জন ঋণ গ্রহীতাকে গত ২১ জানুয়ারি তলব করে হাই কোর্ট।
সাময়িক অবাসায়ক আসাদুজ্জামান খানের দেওয়া তালিকা দেখার পর সেদিন এ আদেশ দেয় উচ্চ আদালত।
সেদিনের আদেশে আদালত ২৮৬ জনকে দুই ভাগে হাজির হতে দিন নির্ধারণ করে দেয়। তাদের মধ্যে ১২২ ঋণ খেলাপি নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির হননি।
এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধে সমন্বিতভাবে কীভাবে কাজ করা যায়, সে বিষয়ে গত ৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের বক্তব্য শোনে আদালত।
তাদের বক্তব্য শোনার পর তলবে হাজির না হওয়া ১২২ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
ওই আদেশে বলা হয়, পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সতর্ক এবং সজাগ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হল।
আর পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) সাময়িক অবাসায়ক (প্রবেশনাল লিক্যুইডেটর) মো. আসাদুজ্জামানকে ওই ১২২ ব্যক্তি বা সত্তার বর্তমান ঠিকানা সরবরাহ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিতে বলা হয় তাকে।