চালুর সময় ঝকঝকে চেহারার মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার এখন অন্ধকারে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই ফ্লাইওভার সন্ধ্যার পর অনেকটা ভুতুড়ে চেহারা পায়। ফলে প্রায়ই রাতে দুর্ঘটনায় পড়ছে যানবাহন, ঘটছে নানা অপরাধ।
Published : 15 Nov 2020, 11:39 PM
মোটর সাইকেলে করে রাতে এই ফ্লাইওভারে ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যুতের খুঁটি থাকলেও সেগুলোতে নেই বাতি। ফ্লাইওভারের কিছু অংশে আশপাশের উঁচু ভবনের আলো পড়লেও বেশিরভাগ অংশ অন্ধকার।
মগবাজারের রাশমনো ক্লিনিকের নিরাপত্তাকর্মী জহিরুল হক জানান, অন্ধকারের কারণে রাতে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যানবাহন খুব একটা চলাচল করে না।
“বাতি নাই দেইখা এমন অন্ধকারে কেউ চলাচল করতে সাহস পায় না। ছিনতাই ও ডাকাতি ছাড়াও দুর্ঘটনার ভয় আছে। রাতে গাড়ি চলে নিচ দিয়া। নিচে যানজট লাইগাই থাকে।”
কারওয়ানবাজার থেকে মোটর সাইকেলে করে নিয়মিত গোড়ানের বাসায় যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, দিনের বেলায় ফ্লাইওভার হয়ে যাতায়াত করলেও রাতে তিনি ওঠেন না।
“রাতে ফ্লাইওভার ভৌতিক মনে হয়। দুর্ঘটনার ভয় আছে। ছিনতাইকারীর হাতে পড়ার ভয়ও আছে।”
গত বছরের ২৬ অগাস্ট রাতে মিলন নামে এক পাঠাওয়ের মোটরাসাইকেল চালকের গলা কেটে তার বাইকটি নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নির্মিত ফ্লাইওভারটি ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর চালু হয়েছে। চার লেইনের এ ফ্লাইওভারে ওঠা-নামার জন্য সাতরাস্তা, সোনারগাঁও হোটেল, মগবাজার, রমনা (হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তা), বাংলামোটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও শান্তিনগর মোড়সহ বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে ১৫টি র্যাম্প।
ফ্লাইওভারের মগবাজার রেলক্রসিং থেকে সাতরাস্তা এবং সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত অংশ ডিএনসিসি আর বাকী অংশ পড়েছে ডিএসসিসি এলাকায়।
ফ্লাইওভারটি উদ্বোধনের মাসখানেকের মধ্যেই বাতিগুলো নষ্ট হতে শুরু করে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ফ্লাইওভারের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে না দেওয়ায় সেগুলো মেরামত বা প্রতিস্থাপন করা হয়নি।
তবে সম্প্রতি ফ্লাইওভারের দেখভালের দায়িত্ব বুঝে পাওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন-ডিএসসিসি বাতি লাগানোসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজের একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে।
ফ্লাইওভারের আলো কবে জ্বলবে জানতে চাইলে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বোরহান উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্প্রতি ফ্লাইওভারের দায়িত্ব বুঝে পেয়েছে ডিএসসিসি। বাতি স্থাপন ও অন্যান্য উন্নয়ন কাজের জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করে তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
“এই প্রকল্পের কাজ আমরা করিনি। করেছিল এলজিইডি। কাজ করার পরপরই বাতিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, খোয়া গেছে। আশা করছি আগামী মাসে অনুমোদন পাশ হবে বলে আশা করছি। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। প্রকল্প অনুমোদন হলে আমরাই ফ্লাইওভারের দেখভাল করব। তখন আর সেখানে অন্ধকার থাকবে না।”
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজের মতে, ফ্লাইওভারে রাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি। অন্ধকারে সেই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, “একটি ফ্লাইওভারে আলো না থাকা বা আলোর স্বল্পতা অবশ্যই সমস্যা তৈরি করবে। ওপরের রাস্তা পরিষ্কার বোঝা যাবে না। গাড়ির হেডলাইটের ওপর নির্ভর করতে হয়, অনেক গাড়ির হেডলাইডে আলো কম থাকলে কনফিউশন তৈরি হয়। আর মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে অনেকগুলো মোড়-লুপ থাকায় এখানে ঝুঁকি আরও বেশি।”
রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড় অংশ ফ্লাইওভারে ঘটলেও দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান জানাতে পারেননি তিনি।
ফ্লাইওভারে যত অঘটন
রাজধানীর অন্য ফ্লাইওভারগুলোর কিছু অংশেও বাতি জ্বলে না ঠিকমতো। বিজয় সরনি-তেজগাঁও ফ্লাইওভারের এক পাশে (বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও যেতে বাম পাশে) বাতি জ্বলে না। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের খিলগাঁও থেকে শাহজাহানপুর নামার অংশটিতে বেশিরভাগ বাতি নষ্ট।
কুড়িল ফ্লাইওভারেও বাতি জ্বলে না ঠিকমতো। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের কিছু বাতি নষ্ট দেখা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, ফ্লাইওভারগুলোয় আলো না থাকার সুযোগে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ ঘটছে। তবে রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলোয় অপরাধের সুর্নিদিষ্ট তথ্য নেই ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে।
ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ডিএমপির পক্ষ থেকে তাগাদা দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ফ্লাইওভারের নষ্ট বাতিগুলো মেরামত বা প্রতিস্থাপন করছে না।
“ছিনতাই ছাড়াও দুর্ঘটনা ঘটছে। অন্ধকারে সাধারণ মানুষ এমনিতেই ভীত থাকে আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করছে।”
ইদানীং ফ্লাইওভারে আড়াআড়িভাবে সুতা ধরে রেখে ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। পুলিশ জানিয়েছে, মোটরসাইকেল আরোহীরা যাওয়ার সময় ধরে রাখা নাইলনের সুতা গলায় আটকে পড়ে গেলে তার টাকা-পয়সা ও জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয় অপরাধীরা।
পুলিশ কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ছিনতাইকারী চক্রের নূরুল ইসলাম, আবদুল্লাহ বাবু ও জালাল নামের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর তারা অনেক ছিনতাই করার কথা স্বীকার করেছে। তারা ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই করত।
পুলিশের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে গত ১০ জুলাই বেঁধে রাখা সুতার ফাঁদে পড়ে মোবাইল ও মানিব্যাগ খুইয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভির জোবায়ের। ১১ জুলাই এ ঘটনার শিকার হন সংবাদকর্মী মোহাম্মদ হোসাইন তারেক। প্রথমটি মগবাজার আর দ্বিতীয়টি সোনারগাঁও হোটেল অংশের ঘটনা।
১২ অগাস্ট সন্ধ্যায় কুড়িল ফ্লাইওভারে এমন ফাঁদে পড়েন শেখ রায়হান কবির। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী অংশে সুতার ফাঁদে পড়ে গলার চামড়া কেটে যায় মাহমুদ রেজা তফুর।
গত ৫ জানুয়ারি রাত সোয়া ১টার দিকে মগবাজার ফ্লাইওভারের সোনারগাঁও হোটেল অংশে মিজানুর রহমান নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যেই তাকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের ভাষ্য। এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বরে কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপর থেকে গামছা প্যাঁচানো চল্লিশ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।