চিকিৎসার নামে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আলোচিত ঢাকার আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।
Published : 10 Nov 2020, 06:06 PM
ওই ঘটনায় আরও একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যিনি একজন চিকিৎসক এবং ওই হাসপাতালের অন্যতম মালিক।
এ নিয়ে মোট ১১ জনকে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হল। তাদের মধ্যে হাসপাতালের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
বরিশাল মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার আনিসুল করিম (৩৫) মানসিক চিকিৎসার জন্য সোমবার আদাবরের ওই হাসপাতালে যান। কিন্তু চিকিৎসার বদলে সেখানে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনায় আনিসুলের বাবা ফাইজ্জুদ্দিন আহমেদ মোট ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন।
মামলার অন্যতম আসামি নিয়াজ মোর্শেদকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার এই ডাক্তার মাইন্ড এইড হাসপাতালের একজন পরিচালক। অসুস্থতার কারণে বর্তমানে তিনি নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।”
এর আগে সকালে পুলিশের এক সংবাদ সম্মেলনে উপ কমিশনার হারুন ওই হাসপাতালের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়ে বলেছিলেন, “এটি একটি হত্যাকাণ্ড। সরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তির কিছু পরেই আনিসুলকে ওই নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়া হয়।”
এর পেছনে ‘দালালদের’ সংশ্লিষ্টতার আভাস দিয়ে উপ কমিশনার হারুন বলেন, “ওই হাসপাতালের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। অবৈধভাবে তারা বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে।”
ওই হাসপাতালে যে ১৬ জন রোগী ছিল, আনিসুলের মৃত্যুর ঘটনার পর সোমবারই তারা অন্য চিকিৎসা কেন্দ্রে চলে গিয়েছিলেন বলে উপ কমিশনার হারুন জানান।
হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, “এটি একটি অবৈধ হাসপাতাল। কোনো অনুমোদন নেই। তাছাড়া পুরো হাসপাতাল ঘুরে একটি জেলখানা মনে হয়েছে। যেখানে নির্যাতন করা হয়েছে, সেটি একটি বদ্ধ ঘর। বাতাস বের হওয়ারও রাস্তা নেই।”
সিভিল সার্জেন মঈনুল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাইন্ড এইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিল।
“কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ব্যবস্থা, জনবল, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা না থাকায় তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে ঘরে পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, সেটি একটি ‘সাউন্ড প্রুফ’ কক্ষ।
“মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য এ ধরনের কক্ষের তো প্রয়োজন নেই। তারা কেন ওই বিশেষ কক্ষটি তৈরি করেছিল, তা তারাই ভালো বলতে পারবে।”
তার বড় ভাই রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পারিবারিক ও পেশাগত কারণে একটা মানসিক চাপ ছিল আমার ভাইয়ের উপর। সে কারণে তাকে ডাক্তার দেখাতে নেওয়া হয়। শুনেছিলাম ওই হাসপাতালটার পরিবেশ তুলনামূলক ভালো।... কয়েজন ভালো ডাক্তার নাকি বসেন, সেজন্যই সেখানে গেছি।”
সেখানে কী ঘটেছিল তার বিবরণ মঙ্গলবার সকালে পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে দেন উপ কমিশনার হারুন।
তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা আনিসুল করিমকে আদাবরের ওই হাসপাতালে নিয়ে যান সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। সেখানে প্রথমে তাকে নাস্তা খেতে দেওয়া হয়।
“কিছুক্ষণ পর তিনি ওয়াশরুমে যেতে চাইলে হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তাকে দোতলায় নিয়ে যান। তার বোন উম্মে সালমা সেখানে যেতে চাইলে তাকে বাধা দিয়ে গেট আটকে দেওয়া হয়।
“আনুমানিক বেলা ১২টার দিকে আরিফ মাহমুদ জয় নিচে এসে আনিসুল করিমের বোনকে দোতালায় নিয়ে যান। সেখানে আনিসুল করিমকে একটি রুমের ফ্লোরে নিস্তেজ অবস্থায় শোয়া দেখতে পান তার বোন। দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা আনিসুলকে মৃত ঘোষণা করেন।”
হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়েছে জানিয়ে উপ কমিশনার হারুন বলেন, “দেখা গেছে কয়েকজন মিলে মারতে মারতে আনিসুল করিমকে হাসপাতালের দোতলার একটি রুমে ঢোকায়। সেখানে তাকে মেঝেতে উপুড় করে শুইয়ে ফেলা হয় এবং তিন-চারজন পিঠের উপর হাঁটু দিয়ে চেপে বসে। কয়েকজন তার হাত ওড়না দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে।
“কয়েক জন আসামি কনুই দিয়ে তার ঘাড়ের পেছনে ও মাথায় আঘাত করে। একজন মাথার উপরে চেপে বসে এবং সকলে মিলে পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্নস্থানে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে আনিসুল করিম নিস্তেজ হয়ে পড়েন।”
এরা হলেন- হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় (৩৫), কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির (২৩), কিচেন শেফ মো. মাসুদ (৩৭), ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান (১৮), ওয়ার্ড বয় জোবায়ের হোসেন (১৯), তানিফ মোল্লা (২০), সঞ্জীব চৌধুরী (২০), অসীম চন্দ্র পাল (২৪), লিটন আহাম্মদ (১৮) এবং সাইফুল ইসলাম পলাশ (৩৫)।
মঙ্গলবার তাদের আদালতে পাঠিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে বিচারক সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে আরিফ মাহমুদ জয় এবং রেদোয়ান সাব্বির ওই হাসপাতালের অন্যতম শেয়ার হোল্ডার।
পরে গ্রেপ্তার ডা. নিয়াজ মোর্শেদ ছাড়াও আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন ময়নাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (অপারেশন) ফারুক মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আসামিদের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং ফাতেমা খাতুন ময়নাও চিকিৎসক।
“তাদের ‘পৃষ্ঠপোষকতায়’ এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। আমরা বাকি চারজনকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”