মহামারীর বন্দি দিনে ঘুড়ির সঙ্গে ক্ষণিক মুক্তি

মহামারীর দিনে লকডাউনে সবাই এখন ঘরবন্দি; তারমধ্যেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ মেললে ঢাকার আকাশে দেখা যায় রঙিন ঘুড়ির ওড়াওড়ি।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2020, 05:44 AM
Updated : 25 April 2020, 06:02 AM

শুক্রবার সকাল থেকেই আকাশের ছিল মুখ ভার। ঘণ্টাখানেক ইলশেগুঁড়ির পর দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি। তাতেই প্রকৃতির রঙ বদলে ঝকঝকে নীল আকাশে দেখা গেল রোদের হাসি। প্রাণঘাতী ভাইরাসের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বিকেলের সেই সোনামাখা রোদে বাড়ির ছাদে উঠে লাটাই ঘুড়িয়েছেন অনেকে।

২৬ মার্চ থেকে চলা এই লকডাউনে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া মানা। এমন পরিস্থিতিতে স্যোশাল মিডিয়া আর টিভি পর্দায় চোখ রেখে ক্লান্ত কেউ কেউ ঘুড়ি উড়িয়ে মুক্তি খুঁজছেন আকাশে।

বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মৃধা বেণুও বলছেন, এই মহামারীর মধ্যে ঢাকার আকাশে ঘুড়ি ওড়া বাড়ার বিষয়টি তাদেরও নজরে এসেছে। লকডাউনের মধ্যে অনেকেই ফেডারেশন থেকে ঘুড়ি ধার নিয়েছেন।

মেরুল বাড্ডা ডিআইটি প্রোজেক্টের ১০ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন সাইফুল ইসলাম। শুক্রবার বিকালে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়িয়েছেন তিনি।

“এখন তো একেবারেই বাইরে বের হচ্ছি না। বাসার বসেই নারকেল পাতার শলা, কাগজ আর পলিথিন দিয়ে পতেঙ্গা ঘুড়ি বানিয়েছিলাম। সুতা বাসাতেই ছিল, শেষমেষ ঘুড়িটা উড়েছে, ওরা (বাচ্চারা) খুব খুশি।”

ডিআইটি প্রোজেক্টে গত কয়েক দিন ধরে ঘুড়ি ওড়া দেখে মেয়ের জন্য স্বামীর কাছে একটি ঘুড়ির আবদার করেছিলেন ফারহানা রহমান।

কিন্তু সেই আবদার পূরণ না হওয়ায় মাঝেমধ্যে মেয়েকে কোলে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে অন্যের ঘুড়ি ওড়ানো দেখেই বিকেলে পার হয়েছে তার।

ফারহানা বলেন, “আমি নিজে কখনও ঘুড়িওড়াইনি। ১৯ মাস বসয়ী মেয়ে তো কাছ থেকে ঘুড়ি দেখেইনি। সবাই সারাদিনই বাসায় থাকছি। এই অবসরে অন্যদের দেখে ঘুড়ি ওড়ানোর ইচ্ছে হয়েছিল। তিন বছর ধরে ডিআইটি প্রোজেক্টে থাকছি আমরা। এর আগে এত ঘুড়ি কখনোই চোখে পড়েনি।”

পুরান ঢাকার বাসিন্দারা সাধারণত পৌষের বিদায়বেলা সংক্রান্তির ‘সাকরাইন’ উৎসবে রঙিন ঘুড়ি ওড়ান। এর বাইরে ঢাকার হাতেগোণা কিছু বাড়ির ছাড় থেকে ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়।

ফাইল ছবি

অন্য সময়গুলোতে বাহারি নকশার সঙ্গে রঙবেরঙের ঘুড়ির দেখা মিলেলেও এই মহামারীর দিনে অনেকেই বাড়িতে বসে কোনোমতে ঘুড়ি তৈরি করেছেন। অবশ্য ভাগ্যবান কেউ কেউ বাজার করতে গিয়েও কিনতে পেয়েছেন।

দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে খিলগাঁওয়ের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম। অন্যদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখে ছেলে-মেয়েরা বায়না ধরায় বাজার করতে গিয়ে কয়েক দিন আগে একটি ঘুড়ি কিনে এনেছেন তিনি।

“এখন মাঝেমধ্যেই আমরা ছাদে উঠে ঘুড়ি উড়াই। বিকালটাও ভালো কাটে, বাচ্চারাও বেশ আনন্দ পায়। ব্যস্ত এই নগরীতে শৈশবের স্মৃতিও কিছুটা ফিরে আসে।”

পুরাতান এলিফ্যান্ট রোডের একটি অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মিজানুর রহমান। বাড়ির ছাদে ওঠার কোনো সুযোগ না থাকায় ইচ্ছে থাকার পরও ঘুড়ি ওড়াতে পারছেন না তিনি।

“মানুষগুলো ঘরে বন্দি থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে। অনেক সময় টিভি দেখতেও ভালো লাগছে না, ফেইসবুকিং করতেও বিরক্ত লাগে। আমাদের বাসার আশপাশে এখন অনেক ঘুড়ি উড়তে দেখি।”

‘ভেন্টিলেশন দরকার’

ঘুড়ি ফেডারেশনের বেণুর ভাষায়, নিজের তৈরি ঘুড়ি আকাশে ওড়ার পর সৃষ্টির যে আনন্দ, তার সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা চলে না। আর মুক্ত প্রকৃতিতে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় কেউ যখন আকাশের দিকে তাকান, তখন মনটাও ‘উদার’ হয়ে যায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই সময়ে আমাদের কাছ থেকে অনেকেই চেয়ে চেয়ে ঘুড়ি নিয়ে গেছেন, অনেকে ধার হিসেবেও নিয়েছেন।

“কেউ কেউ এসে বলছেন- ঘুড়ি দেন, আমাদের তো এখন কিছু করার নেই, আমরা ওড়াবো। আমরাও যতটা সম্ভব বিলি করেছি।”

ঘরবন্দি মানুষের মনের খোরাকও যে দরকার, তা মনে করিয়ে দিয়ে বেণু বলেন, “ভেন্টিলেশনও তো চাই, মনকে তো বেঁধে রাখা যায় না। ফলে সৃষ্টিশীলতা, শিল্প- এসব কিছুর চর্চা হচ্ছে।

লকডাউনের মধ্যে সুযোগ থাকলে ছাদে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে পারলে তা এই মহামারীতে লাখো মানুষের মৃত্যুর খবর আর নিজের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কার মানসিক চাপ থেকে কিছুটা হলেও রেহাই দেবে বলে মনে করেন বেণু।

“ঘুড়ি ওড়াতে গেলে একটু পরিশ্রম করতেই হবে। আকাশের দিকে আমরা সব সময় তাকাতে বলি।... ঘুড়ি ওড়াতে গেলে অন্তত ছাদে যেতে হবে। মুক্ত প্রকৃতিতে আপনি যখন তাকাবেন, আপনার মনটাও উদার হবে।”

ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে ‘কঠিন’ আনন্দ আছে বলে মন্তব্য করে বেণু বলেন, “এখানে প্রযুক্তি আছে। আপনি যখন নতুন ডিজাইন করছেন তখন অ্যারোডিনামিক্স বায়ুসূত্র জয় করে আপনাকে ঘুড়িটি তৈরি করতে হবে। যখন ঘুড়িটি উড়ল, তখন আপনি বিজয়ীয় হাসি হাসবেন, আনন্দিত হবেন; মনে হবে এটা বিরাট অ্যাচিভমেন্ট।”

ঘুড়ি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায়, অন্য খেলায় যেমন প্রতিপক্ষ থাকে, ঘুড়ির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হল নকশা, ঘুড়ি ওড়ার উপযুক্ত হল কিনা সেটাই প্রধান।

“আপনার তৈরি একটি জিনিস, আপনার ইচ্ছায় এবং আপনার ইংগিতে আকাশে উড়ছে, এটা কিন্তু অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার।”