নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্তদের শনাক্ত ও চিকিৎসা দেবেন যারা, সেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই রয়েছেন সুরক্ষা উপকরণ ছাড়া।
Published : 19 Mar 2020, 07:46 PM
এদিকে এই ভাইরাসে বিপর্যস্ত ইতালিসহ অন্যান্য দেশ থেকে ফেরা শত শত প্রবাসী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ায় সারা দেশেই এই রোগাক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এখন বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতে তাদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালে যেসব রোগী আসছে তাদের মধ্যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে তা সহজেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। চিকিৎসক তো হাসপাতালে ওই একটা রোগী দেখেন না, তার আরও অনেক রোগী দেখতে হয়। এ রকম হলে সবার মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট, কোয়ারেন্টিন সুবিধা নিশ্চিতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। তবে সঙ্কট দেখা দিয়েছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ বা পিপিই নিয়ে।
সুরক্ষা উপকরণ না থাকায় আতঙ্কে এরইমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সর্দি-জ্বর ও শ্বাসকষ্টের অনেক রোগীকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে বৃহস্পতিবার সাড়ে তিন ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।
ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই) জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ মানুষ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেয়। এসব উপকরণের মধ্যে রয়েছে প্রতিরোধমূলক পোশাক, হেলমেট, গ্লাভস,বিশেষ ধরনের চশমা, মুখের মাস্ক এবং অন্যান্য বিশেষভাবে তৈরি উপকরণ, যেগুলো জীবাণু সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।
এসব উপকরণ এখনও না পৌঁছানোয় আতঙ্কের মধ্যে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন দেশের কয়েকটি জেলার অন্তত দশজন চিকিৎসক। তবে তারা নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।
ঢাকা বিভাগের এক জেলার একজন মেডিকেল অফিসার বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী আইসোলেশন ইউনিট ও কোয়ারেন্টিনের জন্য আলাদা জায়গা ঠিক করে রাখা হয়েছে। কিন্তু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সামলানোর প্রস্তুতি তাদের নেই।
“যে পিপিই আছে তা দিয়ে কয়েক দিন কাজ চালানো যাবে। তবে এই মুহূর্তে প্রাদুর্ভাব হলে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। আমরা বিষয়টি জানিয়েছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের প্রতি বর্তমান নির্দেশনা হল- আমাদের সার্জিক্যাল মাস্ক যেটা আছে সেগুলো ডাবল করে দেওয়ার। এছাড়া গাউন ও গ্লাভস পরার নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।”
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা হাসপাতালের আরেকজন চিকিৎসক বলেন, তাদের জেলায়ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ নেই।
“কেউ বিদেশ থেকে এসেছেন এমন খবর পেলে মেডিকেল টিম সেখানে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত কেউ ধরা পড়লে কী হবে, তা জানা নেই।
“এ ধরনের সিরিয়াস কেইস ইনভেস্টিগেট করতে হলে কোনো ধরনের প্রটেকশন ছাড়া তা করতে হবে। কারণ আমাদের এখানে মেডিকেল টিমের জন্য ন্যূনতম পিপিই নেই। আমরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছি, আমরা যারা খবর পেয়েই দৌঁড়ে যাচ্ছি।”
বরিশাল বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, সুরক্ষা উপকরণ এখনও সেখানে পৌঁছেনি। মাস্ক, গ্লাভস ও রেইনকোট জোগাড় করে তাদেরকে তা ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
“পিপিই ছাড়া সেবা দেওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের জেলায় যে পাওয়া যাবে না এমনটা তো বলা যায় না। আমরা বিদেশ থেকে আসা যে লোকটাকে পরীক্ষা করছি, তার মধ্যে যে নভেল করোনাভাইরাস নেই সেটা তো আমরা বুঝতে পারছি না। সেক্ষেত্রে একটা ভয়ের জায়গা থেকে যায়। পার্সোনাল সেইফটি ইকুইপমেন্ট বলতে আমরা যা বুঝি তা আমাদের এখানে নেই। মাস্ক আর রেইনকোট পরলে মোটামুটি একটা সুরক্ষা হয়।”
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের এখানে পিপিইর সবগুলো উপকরণ নেই। তবে আশা করছেন দ্রুত এসব এসে পৌঁছাবে।
“আমাদের এখানে মাস্ক, গাউন ও গামবুট রয়েছে। গগলস ও মুখ ঢাকার জন্য বিশেষ ধরনের ক্যাপ এখনও এসে পৌঁছায়নি। এখানে যেগুলো আছে তা দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সম্ভবত তাল মেলানো যায় না। আমাদের যা আছে তা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তবে আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি উপর মহলে জানিয়েছি। দেখা যাক, একটা পথ নিশ্চয়ই বের হবে।”
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাদের হাসপাতালে পিপিই পৌঁছেনি। আশপাশের জেলাগুলোরও একই অবস্থা।
“ঢাকার খবর বলতে পারব না, আমাদের এখানে কিছুই নাই। ভয় নিজের জন্য না। আমরা তো হাসপাতালে জীবাণুর মধ্যে কাজ করি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমার পরিবার, সমাজ আছে। বড় কথা হল, আমি তো এই রোগীকেই দেখছি না। আমি সংক্রমিত হলে আমার কাছ থেকে তাদের মধ্যেও তো এটা ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম।
এই ভাইরোলজিস্ট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যারা আসছে তাদের পরীক্ষা করছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। দেখা গেছে ২০ জনকে পরীক্ষা করে কিছুই পাওয়া যায়নি। কিন্তু একজনের শরীরে পাওয়া গেল।
“তাকে যারা সেবাশুশ্রুষা করছে তারাও তো আক্রান্ত হয়ে গেল। যদি সে নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত না করে।”
সোমবার ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নভেল করোনাভাইরাস রোগী এসেছে শুনে একটি ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও নার্সরা সেখান থেকে সটকে পড়েন।
সেখানে থাকা একজন নার্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাসপাতালে পিপিই ছিল না। সে কারণে ওই রোগীকে সেবা দেবেন কি না তা নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন তারা।
“শুনেছি ওই রোগী নাকি সৌদি থেকে এসেছেন। তার মধ্যে কভিড-১৯ এর কিছু লক্ষণ ছিল। আমাদের এখানে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ না থাকায় কিছুটা আতঙ্কে ছিলাম। ধরে নিলাম তিনি সুস্থ, কিন্তু যদি সত্যিই তিনি আক্রান্ত হতেন তাহলে কী হত?”
এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিভিন্ন হাসপাতালে সুরক্ষা উপকরণ পাঠানো শুরু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সকালেই দশ হাজার পিপিই সংগ্রহ করেছে সিএমএসডি (কেন্দ্রীয় মেডিকেল স্টোর ডিপো)। আরও দশ লাখ পিপিই সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে যার জন্য যে ধরনের পিপিই দরকার, তা সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“তিন মাসের মজুদ হয়ত একসঙ্গে দিতে পারব না। কিন্তু সাপ্তাহিক এমনকি দৈনিক ভিত্তিতে তাদের যে নিরাপত্তা উপকরণ আছে তা আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি। রাজশাহীর বিষয়টি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গতকাল পাঁচশটি পিপিই দেওয়া হয়েছে।”
“আমি নির্দেশ দিয়েছি বাসস্ট্যান্ড থেকে যে বাসটি আগে ছেড়ে যাবে সেই বাসে আমরা গিয়ে দিয়ে আসব। তারা সেখানে পৌঁছে দিবে। এভাবে আমরা কাজ করছি। কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে পিপিইর কোনো অভাব হবে না।”
নভেল করোনাভাইরাসকে জাতীয় দুর্যোগ উল্লেখ করে নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে চিকিৎসকদের প্রতি আহ্বান জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
তিনি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ নিশ্চিতের এই আশ্বাস দিলেও তার সংগ্রহ পর্যাপ্ত কি না সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল, বিডিএমসির হিসাবে দেশে রেজিস্টার্ড নার্স রয়েছে ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন। আর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, বিএমডিসির হিসাবে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৯২৭ জন।
এর বাইরে হাসপাতালে ওয়ার্ড বয়, নিরাপত্তাকর্মী, প্রশাসন ও অন্যান্য শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।