উত্তরের এক কেন্দ্রে সারা দিনের ভোটচিত্র

বিএনপিসহ নানা মহলের শঙ্কা, উদ্বেগের মধ্যে ইভিএমে হয়ে গেল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ভোটের আয়োজন, সব দলের অংশগ্রহণের এই নির্বাচন কেমন হল তা বুঝতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি কেন্দ্রে সারা দিন চোখ রেখেছেন একজন প্রতিবেদক।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2020, 04:25 PM
Updated : 1 Feb 2020, 07:29 PM

রাজধানীর পূর্ব রামপুরার নলেজ সিন্ডিকেট কিন্ডারগার্টেন স্কুল কেন্দ্রে শনিবার সকালে ভোট শুরুর আধা ঘণ্টা আগে থেকে অবস্থান নেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক তাবারুল হক

দিনের নানা সময় কেমন ছিল ভোটার উপস্থিতি, সব দলের এজেন্ট ছিল কি না, ইভিএমে ভোট দিয়ে ভোটারদের কী অভিজ্ঞতা, আঙুলের ছাপ নিয়ে কাউকে বেগ পোহাতে হয়েছে কি না, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তাদের কথা-বার্তা- ভোট সংক্রান্ত সব কিছুর আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন তিনি।

উত্তর সিটি করপোরেশনের এক হাজার ৩১৮টি কেন্দ্রের মধ্যে স্থানীয় ২২ নম্বর ওয়ার্ডের এ কেন্দ্রে ভোটগ্রহন শুরুর পর পর সকালে উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে কেন্দ্রমুখী হতে দেখা যায় ভোটারদের। তবে দুপুরের পর সেই পরিস্থিতি পাল্টে আবারও ভোটারদের আসা কমে যায়।

ভোট শেষে বিকাল পৌনে ৫টায় কেন্দ্রে ফলাফলও ঘোষণা করেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান।

সকাল সাড়ে ৭টা: ভোটের আগে কেন্দ্রের প্রস্তুতি

তখন সকাল সাড়ে ৭টা, ভোটকেন্দ্রের দরজায় বিভিন্ন প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের জটলা। এর মিনিট পাঁচ পর তাদের কেন্দ্রের ভেতর প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।

এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী লিয়াকত আলী এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ফয়েজ আহমেদ ফরুর এজেন্টদের কেন্দ্রের ভেতরে যেতে দেখা যায়। নৌকার মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম, ধানের শীষের তাবিথ আউয়ালের এজেন্ট ছাড়াও অন্যান্য প্রার্থীদের এজেন্টদের দেখা যায়।

ভোট শুরুর আগে কেন্দ্রে উপস্থিত সব এজেন্টের সামনে ভোটগ্রহণের প্রতিটি বুথে ইভিএম মেশিন থেকে কাগজে একটি করে প্রিন্ট নিয়ে শূন্য ভোট দেখানো হয়।

এরপর এতে পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষর নিয়ে সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর নির্দেশ দেন প্রিজাইডিং অফিসার।

সকাল ৮টা: ভোট শুরুর চিত্র

দুই হাজার ৪১২ জন ভোটারের এ কেন্দ্রে সকাল ৮টার দিকে ভোটার ছিল না বললেই চলে। কেন্দ্রের ছয়টি বুথে ভোট শুরুর ৭ মিনিটের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ভোটার কেন্দ্রে প্রবেশ করেন।

এ সময় ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কর্মকর্তারা ভোটারদের ‘অভ্যর্থনার’ দিয়ে এক ধরনের কদর করেই যেন ভোটকক্ষে নিয়ে যান।

এরপর এক এক করে এই পুরুষ ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে আসতে থাকেন ভোটাররা। শুরুতে ভোট দেন ৬৫ বছর বয়সী আমজাদ হোসেন সরকার। এই প্রবীণ এর আগে কখনও ইভিএমে ভোট দেননি।

তিনি ভোটকক্ষে যাওয়ার পরই বুথে দায়িত্বরত সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার তাকে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি বলে দেন।

এরপর ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটে আঙুলের ছাপ দিলে মনিটরের স্ক্রিনে আমজাদ হোসেনের ছবি ভেসে উঠে। সঙ্গে নাম-ঠিকানাও মিলে যায়।

এরপর তিনি ‘গোপন কক্ষে’ গিয়ে ব্যালট ইউনিটে পছন্দের প্রতীকের পাশে টিপ দেওয়ার পর ভোট দেওয়া নিশ্চিত করেন।

সকাল ৮টা- ১০টা: ভোট দিলেন ১০৬ জন

এক-দুইজন করে ভোটার আসছেন। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ভোটারদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বেলা বাড়ার সাথে ভোটারও বাড়ছিল। কিন্তু তখনও কেন্দ্রের সামনে ভোটারদের কোনো লাইন ছিল না।

দুই ঘণ্টা পর সকাল ১০টায় এই কেন্দ্রের ছয়টি বুথের ফলাফল এক করে প্রিজাইডিং অফিসার জানালেন, প্রথম দুই ঘণ্টায় মোট ১০৬ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন।

সকাল ১০টা- বেলা ১২টা: এবার দ্বিগুণ ভোটার উপস্থিত

প্রথম দুই ঘণ্টার চেয়ে একটু বাড়তে থাকে ভোটার উপস্থিতি। তখনও ভোটারদের লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। তবে উপস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ভেতরে ভোট চলার কারণে দুই-চারজনকে বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

ভোটারদের আগমন একটু বাড়তে থাকা দেখে দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যরা তিনটি চেয়ার বসিয়ে ভোটারদের সিরিয়াল নির্ধারণ করে দেন। এভাবে ভোট চলছিল বেশ কিছুক্ষণ।

বেলা ১২টায় ভোটের চার ঘণ্টায় ৩০০ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন বলে জানান প্রিজাইডিং অফিসার।

১২টা থেকে দুপুর ২টা: এ দুই ঘণ্টায় ১৭০ ভোট

হঠাৎ ভোটকেন্দ্রের সামনে ভোটারদের ছোট্ট লাইন। তখন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বলাবলি করছিলেন, যাক এবার বুঝি ভোটারদের ধাক্কা পড়বে।

কর্মকর্তাদের একজন বলেই ফেললেন, “ছোটবেলা যখন আমরা ভোট দেখতে কেন্দ্রের সামনে যেতাম তখন দেখতাম, ভোটারদের উপস্থিতির কারণে বাঁশের বেড়া ঠেলে ভেঙে দেওয়া হত। আর এখন কেন্দ্রে মশা মারার মতো পরিস্থিতি হয়েছে।”

ভোটারদের কয়েক মিনিটের লাইন যেন আর টিকল না। যেই-সেই! আবারও ভোটারের ধস!

দুপুর ২টা শেষে বুথে বুথে গিয়ে সংখ্যা এক করে প্রিজাইডিং অফিসার জানালেন, মোট ৪৭০টি ভোট পড়েছে।

দুপুর ২টা- বিকাল ৪টা: শেষ দুই ঘন্টায় ১০৫ ভোট

ভোটের বাকি আর দুই ঘণ্টা। তখনও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্যদের আকাঙ্ক্ষা, এবার বুঝি ভোটের শেষ ধাক্কাটা লাগবে! অনেকেই বলাবলি করছিলেন, কাউন্সিলর প্রার্থীদের আত্মীয়-স্বজনরাও অনেকে ভোট দেওয়ার বাকি, তারা আসলেও তো হাজারখানেক ভোট হত।

একজন নির্বাচন কর্মকর্তা এক পোলিং এজেন্টের উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের বাড়ি-ঘরের লোকদেরও তো কেন্দ্রে পাঠাতে পারেন।”

কিন্তু শেষ দুই ঘণ্টায় ভোটার উপস্থিতি আরও কমে যায়।

বিকাল ৪টায় ভোট শেষ হয়। কেন্দ্রের চৌহদ্দিতে অপেক্ষায় ছিল না কোনো ভোটার।

কোনো প্রার্থীর এজেন্ট বের হয়ে আসেননি বা কাউকে বের করে দেওয়া হয়নি। এমন অভিযোগও পাওয়া যায়নি।

ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ৪৫ মিনিট পর প্রিজাইডিং অফিসার কামরুজ্জামান জানালেন, তার কেন্দ্রে মোট ৫৭৫ জন ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ শেষ দুই ঘণ্টায় ভোট দিয়েছেন ১০৫ জন ভোটার।

কেন্দ্রের ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে প্রার্থীর এজেন্ট ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা-নিরাপত্তা সদস্য, কারিগরি টিমের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রক্রিয়া শেষ করে ফল ঘোষণার পালা। ভোট শেষের ৪৫ মিনিটের মধ্যে কেন্দ্রভিত্তিক ফল দিয়ে কেন্দ্রের দেয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়।

ইভিএম নিয়ে যা বললেন ভোটাররা

এই কেন্দ্রে প্রথম ভোট দেওয়া আমজাদ হোসেনের কাছে ইভিএমে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেশিনে ভোট দেওয়া তো সহজ। এবার সিস্টেমটা ভালো, চুরিধারির কোনো সুযোগ নেই।"

সকাল সাড়ে ৯টায় ভোট দেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ৬৫ বছরের ফজলুল হক।

তিনি বলেন, “গত জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারিনি। সেই সময় একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। এবার তো পরিবেশ ভালো, মেশিনে সুন্দরভাবে ভোট দিতে পারলাম।”

তবে ফলাফল কী হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ফজলুল হক বলেন, “ভোট তো পছন্দের মার্কায় দিয়েছি। তবে মেশিনের ভেতরে কী আছে সেটা তো জানি না।”

তরুণ ভোটার শাওন মাহমুদ বলেন, “আমি প্রথম ভোটার। ইভিএমেই ভোট দিয়ে আমার ভোট শুরু হয়েছে। আমার কাছে সিস্টেমটা ভালো লেগেছে। পরিবেশটাও সুন্দর, কিন্তু ভোটার কম মনে হচ্ছে।”

স্থানীয় কাউন্সিলর প্রার্থীরা যা বললেন

সকালেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত মিষ্টি কুমড়া প্রতীকের প্রার্থী মো. লিয়াকত আলী কেন্দ্রে আসেন। ঘুরে ঘুরে ভোটারদের ভোট দান দেখে যান তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকমের জিজ্ঞাসায় এই প্রার্থী বলেন, “আমি চাই শান্তি-শৃঙ্খলার মাধ্যমে ঝামেলামুক্ত ভোট হোক। এর মাধ্যমে জয়-পরাজয় হবে। ভোটারদের প্রতিনিধি নিশ্চিত হবে।”

ইভিএমে ভোট দেওয়া অনেকটা সহজ এবং ভোটারদের কোনো সমস্যা হয়নি বলে দাবি করেন ২২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে একাধিকবার নির্বাচিত এ কাউন্সিলর।

অপরদিকে বিএনপি সমর্থিত ঘুড়ি প্রতীকের প্রার্থী ফয়েজ আহমেদ অভিযোগ করেন, কিছু কিছু কেন্দ্রে তার এজেন্টদের প্রতিপক্ষের লোকেরা ঢুকতে দেয়নি। প্রশাসনের লোকদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।

অবশ্য ভোটারদের উপস্থিতি কম হলেও কেন্দ্রের ভেতর কোনো ঝামেলা হয়নি বলে জানান তিনি।

আঙুলের ছাপ নিয়ে বিড়ম্বনা

পুরো ভোটের আট ঘণ্টায় অন্তত ১২ জন প্রবীণ ভোটারকে আঙুলের ছাপ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। তবে তাদের কাউকে ভোট না দিয়ে ফিরতে হয়নি।

একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলার পর হাত ধুয়ে আসার পরামর্শ পেয়ে ওয়াশ রুমে ছুটেন তিনি।

সেখানে দেয়ালে বেশ কিছুক্ষণ আঙুল ঘঁষতে দেখা যায় তাকে। তারপর হাত ধুয়ে আসেন ভোটকক্ষে। তাতেও মেলেনি ছাপ।

প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তার ভোটার নম্বর দিয়ে শনাক্তকরণের পর ভোট দেওয়ার সুযোগ দেন।

“আঙুলের ছাপ না মিললে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করে আমাদের কাছে কেন্দ্রের মোট ভোটের ১ শতাংশ বিষয়ে সুযোগ ছিল। কারও কারও মিলে গেছে, যাদের মেলেনি তাদের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছে,” বলেন প্রিজাইডিং অফিসার।

এ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যানও তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।

ফলাফল: বিকাল ৫টার মধ্যে

এ কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থী নৌকা প্রতীকের আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন ২৫৪ ভোট। আর ধানের শীষের তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ২৮০ ভোট।

আর সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী আওয়ামী লীগের লিয়াকত আলী মিষ্টি কুমড়া প্রতীকে পেয়েছেন ২৮০ ভোট এবং বিএনপির ফয়েজ আহমেদ ফরু ঘুড়ি প্রতীকে ২৯২ ভোট পেয়েছেন।

এদের বাইরে ২২, ২৩ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে পাঁচজন প্রার্থী ছিলেন। তাদের মধ্যে এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সর্বোচ্চ সংখ্যক, ২৪৮ ভোট পেয়েছেন।

বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ইভিএমসহ কেন্দ্রের আনুসঙ্গিক নির্বাচনী মালামাল নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার ‘ফল সংগ্রহ ও পরিবেশ’ কার্যালয়ের দিকে যাত্রার প্রস্তুতি নেন নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা।