নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চীনের অবরুদ্ধ নগরী উহান থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের নেওয়া হচ্ছে বিমানবন্দরে।
Published : 31 Jan 2020, 05:40 PM
তাদের আনতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ শুক্রবার বিকাল পৌনে ৬টার দিকে ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে উহানের পথে।
চীন থেকে দেশে ফিরতে ১৯টি পরিবার, ১৮ শিশু এবং দুই বছরের কম বয়সী দুই শিশুসহ ৩৬১ জন নিবন্ধন করেছেন বলে সকালে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের ডিজিএম তাহেরা খন্দকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে উড়োজাহাজ রওনা হয়েছে তাতে আসন আছে ৪১৯টি। বাংলাদেশ সময় রাত ২টায় তারা ঢাকায় পৌঁছাবেন বলে আমরা আশা করছি।”
উহানের হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিরে শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুক্রবার দুপুরে চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় তাদের বাসে করে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
“আমাদের ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশি আছে ১৩৭ জন, আমরা সবাই আসছি। রওনা হওয়ার আগে আমাদের সবার শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়েছে।”
মধ্য চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। এ ভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় এর লক্ষণগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মত।
নভেল করোনাভাইরাস এর কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এমন কোনো চিকিৎসা এখনও মানুষের জানা নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে। আপাতত একমাত্র উপায় হল, যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বা এ ভাইরাস বহন করছেন- তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং কিছু স্বাস্থ্য বিধি ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে চলা।
গত এক মাসে কেবল চীনেই দশ হাজার মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ২১৩ জনের।
চীনের বাইরে আরও ১৮ দেশে প্রায় একশ মানুষ নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় এবং কয়েক জায়গায় মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর খবর আসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন করোনাভাইরাসের এ প্রাদুর্ভাবকে ‘বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে।
ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে উহান শহর কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে গত দশ দিন ধরে। ফলে অনেকের ঘরেই খাবারে টান পড়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি আক্রান্ত হওয়ার খবর না থাকলেও উহানে ভাইরাস আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সবার দিন কেটেছে আতঙ্কের মধ্যে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শুক্রবার সকালে শাহজালাল বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঢাকা ফেরার পর সবাইকে আশকোনো হজ ক্যাম্পে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশের সঙ্গে সেনা সদস্যরাও থাকবেন।
পর্যবেক্ষণের এই সময় তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য স্বজনরা যেন ব্যাকুল না হয়ে পড়েন সেজন্য তাদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে সরকার। সকালে তিনি আশকোনা ঘুরে এসেছেন।
সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি নিয়মিত হাত ধোয়া এবং পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দিয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, “কারও মধ্যে যদি লক্ষণ প্রকাশ পায়, তবে হটলাইনে যোগাযোগ করা বা ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে। টেলিফোনে বা লোক পাঠিয়ে হিস্ট্রি নিয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব। নিজে নিজে হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। তাতে রোগ ছড়াতে পারে।”
বিমানে যা যা যাচ্ছে
মুশতাক হোসেন জানান, চীন থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার সময় সতর্কতা বজায় রাখতে বেশ কিছু সরঞ্জাম বিমানে করে পাঠানো হয়েছে।
এ বিমানের যাত্রী, স্বাস্থ্য কর্মী ও ক্রুদের জন্য বিশেষ নির্দেশিকাও দেওয়া হয়েছে।
# সকল যাত্রী চীন (উহান) থেকে বিমানে ওঠার সময় কেবিন ক্রু প্রত্যেক যাত্রীকে একটি করে মাস্ক সরবরাহ করবেন।
# আসনে বসার পরে যাত্রীদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হেলথ ডিক্লারেশন ফরম দেওয়া হবে।
# ডাক্তাররা বিমানের সবাইকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বার্তা দেবেন।
# বাচ্চাদের হাঁচি-কাশি দেখা দিলে টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে ফেলে ব্যবহার করা টিস্যু পেপার সিট পকেটে রাখা এয়ার সিকনেস ব্যাগে ফেলতে হবে।
# হেলথ ডিক্লারেশন ফরমটি যাত্রী যথাযথভাবে পূরণ করলেন কিনা সে বিষয়ে সহায়তা করতে হবে।
# যাত্রীদের আশ্বস্ত রাখতে হবে।
# যাত্রীরা কেউ অসুস্থ বোধ করলে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
# ক্রু হেলথ ডিক্লারেশন ফরম সংগ্রহ করে চিকিৎসকের হাতে দেবেন।
# চিকিৎসকরা হেলথ ডিক্লারেশন ফরমগুলো পর্যালোচনা করবেন এবং কোনো লক্ষণ আছে কি না তা দেখবেন। যদি কারো মধ্যে লক্ষণ থাকে, তাকে আলাদা করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখবেন এবং জ্বর পরীক্ষা করবেন। এ সময় ডাক্তার এন৯৫ মাস্ক ও ডিসপোজেবল গাউন ব্যবহার করবেন। বিমানের পাইলটের মাধ্যমে অসুস্থ যাত্রীর তথ্য ঢাকা বিমানবন্দরে জানাবেন। বিমান অবতরণের পরে অসুস্থ যাত্রীকে নির্দিষ্ট হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বিমান বন্দরের চিকিৎসক টিম ব্যবস্থা নেবেন।
# ডাক্তার/ক্রু যাত্রীদের জ্বর পরীক্ষা করবেন ডিজিটাল হ্যান্ড হেল্ড থার্মোমিটার দিয়ে।
# কেবিন ক্রু, ডাক্তার ও যাত্রীরা দুই ঘন্টা পরপর হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করবেন।
# বিমান ঢাকায় অবতরণের সময় বিমানের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ ৩ জন কর্মকর্তা বিমানে উঠবেন।
# নিজ নিজ হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে যাত্রীরা বিমান থেকে নামবেন এবং নির্ধারিত বাসে উঠবেন।
# ওই বাসের চালক ও হেলপার সবাইকেই গাউন, মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের চীন প্রতিনিধি ছাইয়েদুল ইসলাম, নিজস্ব প্রতিবেদক মাসুম বিল্লাহ ও গোলাম মুজতবা ধ্রুব]
আরও পড়ুন –