অবরুদ্ধ উহান থেকে ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশিরা

প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চীনে অবরুদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা দেশে ফিরতে মুখিয়ে আছেন; ফেরানোর প্রক্রিয়া চললেও কবে তা শুরু হবে এখনো অজানা।

মাসুম বিল্লাহ ঢাকা ও ছাইয়েদুল ইসলাম, চিয়াংশিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2020, 04:07 PM
Updated : 30 Jan 2020, 04:15 PM

যে শহর থেকে ওই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলা হচ্ছে, সেই উহানে আটকে পড়া কয়েকজন শিক্ষার্থী বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে ফিরতে চান তারা। সেক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পুরো ধাপ পেরোতেও তারা রাজি।

এদিকে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস উহানে থাকা শিক্ষার্থী ও গবেষকদের তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। তাদের বেশিরভাগই দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি আক্রান্ত হওয়ার খবর না থাকলেও উহানে ভাইরাস আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় আতঙ্ক বাড়ছে শিক্ষার্থীদের।

দেশে ফিরতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত গবেষক ড. রেজা সুলতানুজ্জামান জানান, উহানের ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশে ফেরার বিষয়ে ৩৭১ জন শিক্ষার্থীর তথ্য নিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস।

তাদের মধ্যে ৩২১ জন বয়স্ক এবং ১৯ শিশু দেশে ফিরতে ইচ্ছুক বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি ৩১ জন এই মুহূর্তে দেশে ফেরার আগ্রহ দেখাননি।

চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ১৭০ জনের। কেবল চীনেই আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ৭৭১ জনে।

আর চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে আরও ১৯ জায়গায় শতাধিক মানুষের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে চীনের বাইরে এ ভাইরাসে কারও মৃত্যুর তথ্য এখন পর্যন্ত আসেনি।

উহান যে প্রদেশের রাজধানী, সেই হুবেইয়ের প্রায় ৬ কোটি মানুষ আংশিক বা পুরোপুরি অবরুদ্ধ দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। উহানের বাসিন্দাদের অবরুদ্ধ দশার নয় সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে। সেখানে গণপরিবহন বন্ধ, রাস্তাঘাট একেবারে জনমানবশূন্য, দোকানপাটও খুলছে খুব কম। ফলে সবারই খাবারে টান পড়েছে।

হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, আবাসিক হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাবার সরবরাহ করা হলেও তা অপ্রতুল। বদ্ধ ঘরে আতঙ্কের মধ্যে তাদের দিন কাটছে।

এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী রাকিবুল তূর্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখানে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছি। দরজা-জানালাও খোলা নিষেধ। ডরমিটোরির ক্যান্টিন থেকে খাবার দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু একটানা রুমের মধ্যে বসে থাকা কঠিন।”

দেশে ফিরতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, ”দূতাবাস একটি ফর্মের মাধ্যমে আমাদের তথ্য নিয়েছে। তারা বলছে, দেশে ফিরিয়ে নেবে আমাদের। আসল ব্যাপার হচ্ছে, উহান থেকে ভাইরাসের উৎপত্তি হওয়ায় এবং আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় কেউ থাকতে চাইছে না।”

হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহে দূতাবাসের কাজের সমন্বয় করেছেন শিক্ষার্থী নওশাদ।

তিনি জানান, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩৭জন শিক্ষার্থী অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। দুয়েকজন ছাড়া বাকিরা দেশে ফিরতে চান।

”আমরাতো কেউ আক্রান্ত না। আক্রান্ত হওয়ার আগেই আমরা দেশে ফিরতে চাই। এর আগে আমাদের পরিপূর্ণ চেকআপ করা হোক, যাতে আমরা দেশে ফিরে ভাইরাসের সন্দেহ থেকে দূরে থাকতে পারি।”

সার্বক্ষণিক এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে জানিয়ে নওশাদ বলেন, “কেউ হাঁচি-কাশি দিলেই আমরা ভয় পেয়ে যাচ্ছি। সবার মধ্যে কেমন আতঙ্ক- বলে বোঝাতে পারব না।”

এই প্রদেশের ইচাং শহরের থ্রি গর্জেস ইউনিভঅর্সিটিতে লেখাপড়া করা ইফতেখার হাসান সৌরভ  জানান, তাদের পরিস্থিতিও উহানের মতই। ফেইসবুকে এক ভিডিওতে তিনি নিজেদের অবস্থার বিবরণ তুলে ধরেছেন।

 

করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহান থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিলেও চীন সরকারের আপত্তিতে তা সম্ভব হচ্ছে না বলে তিন দিন আগে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেছিলেন, “আমরা প্লেনও রেডি করেছি। আমরা চীনা সরকারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা বলেছে যে, আগামী দুই সপ্তাহ বা কমপক্ষে ১৪ দিন ওদেরকে আসতে দেবে না।”

বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “চীন সরকার যখন তাদের অনুমতি দেবে তারা তখন আসবেন। আমাদের ৩৭০ জন নাগরিক দেশে আসতে চান। তাদের আলাদাভাবে রাখতে হাসপাতালে বিশেষ আয়োজন করেছি। আনার পরে দায়িত্ব স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। তবে আনন্দের বিষয়, আমাদের কেউ আক্রান্ত হননি।”

আপাতত ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উহান শহরে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন সরকার। এর মধ্যে বুধবার বিশেষ বিমানে করে ২০৬ জন নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে জাপান। একইভাবে দেশে ফিরেছেন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার কয়েকশ নাগরিক।

দেশে ফেরার বিষয়ে এক প্রশ্নে হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, “জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরাও ফিরতে চাই। তবে ৬ ফেব্রুয়ারির পর হয়ত এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, দেশে ফিরলেও তার আগে পরিপূর্ণ চেকআপ ও চিকিৎসা চাই, যাতে আমাদের মাধ্যমে দেশে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকে। প্রয়োজনে আমরা ১৪ দিন আলাদা জায়গায় থাকতেও রাজি আছি। কারণ আমরাতো এখানেও আছি বন্দি অবস্থায়। এই অবস্থা কবে কাটবে তারও ঠিক নাই।”

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খাবার সরবরাহ করলেও তা চাহিদার তুলনায় কম জানিয়ে হাবিব বলেন, “দেখা যাচ্ছে দরকার ১ কেজি, দিচ্ছে ২৫০ গ্রাম। তাদেরওতো কিছু করার নাই। যেহেতু খাবার আনতে হচ্ছে ৫০-১০০ কিলোমিটার দূর থেকে।”

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্য জায়গার বাংলাদেশিরাও খাদ্য সংকটের মধ্যে আছেন বলে জানান তিনি।

উহানের সেন্ট্রাল চায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল্লাহ আল ফাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হয় তা বলা যাচ্ছে না, তাই এই মুহূর্তে আমি দেশে ফিরতে চাই। তবে অবশ্যই যেন দেশে যাওয়ার পর পরবর্তী কিছু দিন বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখার ব্যবস্থা হয়। তা না হলে দেশে ফেরাটা কাল হতে পারে।

“বাংলাদেশ দূতাবাস বিশেষ ব্যবস্থায় আমাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এখন সেই অপেক্ষায় আছি।”

বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জানান, উহান ও এর আশেপাশের কয়েকটি এলাকায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস একটি হটলাইন চালু করা হয়েছে। সপ্তাহে সাত দিন +86 178-0111-6005 নম্বরে ফোন করে চব্বিশ ঘণ্টা সহায়তা পাওয়া যাবে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি বলেও বলেন জানান ওই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “আমরা এখন তথ্য সংগ্রহের পর্যায়ের আছি। একইসঙ্গে কীভাবে তাদেরকে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে ফেরানো হবে, সে বিষয়ে চীন সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি।”

আরও পড়ুন