যার নেতৃত্বে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যূদয়, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সমৃদ্ধ একটি দেশ, গণতান্ত্রিক যে দেশে থাকবে না শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা।
প্রায় অর্ধশতকের পথচলায় কতটুকু এগিয়েছে বাংলাদেশ?
১০ বছর আগে সরকার পরিচালনায় আসীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির জনকের সেই স্বপ্নের দেশ গড়ার উপরই নিবদ্ধ করেছিলেন দৃষ্টি; নিয়েছিলেন স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা।
নতুন বছরের বাণীতে সেই পথে চলার অঙ্গীকারই আবার করেছেন তিনি।
নববর্ষের বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “নতুন বছরের অঙ্গীকার হোক মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের।”
সেই পথচলায় জাতির পিতার জন্ম শত বার্ষিকীতে প্রেরণা খুঁজেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
“২০২০ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী সাড়ম্বরে উদযাপিত হবে। এ জন্য গোটা দেশবাসী উন্মুখ হয়ে আছে। নববর্ষ সকলের মাঝে জাগায় প্রাণের নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা।”
শেখ হাসিনা বলেন, “২০২০ বাঙালি জাতির জন্য একটি বিশেষ গৌরবময় বছর। এ বছরই উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। আমরা ২০২০ খ্রিস্টাব্দকে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছি।”
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ শুরু হবে মুজিব বর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন; তারপর বছরব্যাপী রয়েছে নানা আয়োজন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই আয়োজনকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার প্রয়াসও রয়েছে সরকারের।
বিদায়ী বছরের অর্জন তুলে ধরে বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “উন্নয়ন, সংবিধান ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ২০১৯ ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বছর। এ সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে।”
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর আরও দুটি নির্বাচনে আরও শক্তি নিয়ে তার ক্ষমতারোহণে এই পর্যন্ত উন্নতির অনেক সোপান পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে অগ্রযাত্রায় প্রবৃদ্ধি ছাড়িয়েছে ৮ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯০৯ মার্কিন ডলার। শিক্ষার হার ৭৩.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের ঘর আলোকিত এখন বিদ্যুতের আলোয়।
কিন্তু এই উন্নয়নকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে বিএনপি বলছে, দেশে এখন গণতন্ত্র নেই, সেটাই বড় সঙ্কট।
নতুন বছরের আগমনী বার্তায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “এই বছরটি ছিল গণতন্ত্র ধ্বংসের বছর।… এবার আওয়ামী লীগ ভিন্ন কায়দায় একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে পুরো বছরজুড়েই।”
২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার পর ২০১৮ সালের শেষ লগ্নে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়ের মালা পরলেও অভিযোগের মালাও ছিল বড়।
‘ভোট ডাকাতি’র মধ্য দিয়ে জনগণের রায়কে ছিনিয়ে নেওয়া হয় বলে বিরোধীদের অভিযোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলও প্রশ্ন তোলে ওই নির্বাচন নিয়ে।
তারপর থেকে মত প্রকাশের অধিকার ক্রমেই সঙ্কুচিত করে আনা হচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগের সঙ্গে গলা মেলায় দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও।
বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড এই অভিযোগকে আরও জোরাল করে। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর বারবার আক্রান্ত হয়েও বলেছেন মত প্রকাশের অধিকার দিচ্ছে না সরকার।
২০১৯ সালের পর্যালোচনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, বিদায়ী বছরে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক।
বিএনপির ভাষায়, “গণবিরোধী শক্তি জনগণের সকল অধিকারকে বন্দি করে রেখেছে।”
ফখরুল বলছেন, “গত ১০ বছরে বাংলাদেশে শুধু ভিন্নমত, ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তার কারণে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষকে মামলার আসামি করা হয়েছে। মামলা দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৪৮১৪টি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সরকারের হাতে এবং আওয়ামী লীগের হাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা মারা গেছেন ১৫২৬ জন এবং গুম হয়েছে বিএনপির ৪২৩ জন এবং মোট ৭৮১ জন।”
গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিরোধীদের কথার জবাবে উন্নয়নকে ঢাল হিসেবে দেখিয়ে আসছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। উন্নয়নের জন্য সরকারের পরিবর্তনের বদলে স্থিতিশীলতার কথাও ঘুরেফিরে আসছে তাদের মুখে। যদিও উন্নয়নের সঙ্গে ধনী-গরিব বৈষম্যও যে বাড়ছে, তার স্বীকারোক্তি এসেছে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কাছ থেকেও।
বড় বড় উন্নয়ন কাজে দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ আসছে বিরোধী নেতাদের কাছ থেকে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্পে বালিশকাণ্ড, মেডিকেল কলেজের পর্দাকাণ্ডে নতুন দুর্নীতির খবর যেমন প্রকাশ পেয়েছে, বছরের শেষ ভাগে ক্যাসিনোকাণ্ডে দলীয় নেতাদের সংযোগ কিছুটা হলেও বিব্রতকর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলকে।
আবার দুর্নীতির অভিযোগের মুখে থাকা ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছে ঘুষ চাওয়ার অডিও টেপ ফাঁস দুর্নীতি দমন সংস্থার কর্মকর্তাদেরও দাঁড় করিয়ে দেয় কাঠগড়ায়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’র কথা বলে ক্ষমতাসীনরা ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত দলীয় নেতাদের বহিষ্কার ও গ্রেপ্তার করালেও অর্থনীতির সূচকগুলো এখন সরকারকে ভাবিয়ে তোলার মতো নিচে নেমেছে।
এক বছর আগেও যে সব সূচকের উপর ভর করে অর্থনীতির তরতরিয়ে এগিয়ে চলার কথা অর্থমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের মুখে মুখে ছিল, তাতে এখন হতাশার চিত্র।
রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে, রাজস্ব আদায় কমছে, মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী, আমদানি কমছে, চাপে আছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিনিয়োগে। প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে ডুবতে বসেছে ব্যাংক খাত। পুঁজিবাজারও পতনের ধারায়।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই এখন নেতিবাচক বলে ৫ মাসেই ব্যাংক থেকে পুরো অর্থবছরের ঋণ নিয়ে ফেলতে হয়েছে সরকারকে।
বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্কটের প্রভাব থেকে এতদিন সযতনে নিজেকে বাইরে রাখতে পারলেও এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকারের আত্মতুষ্টিকে কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন ছিল, সেটা খাওয়াইনি। অর্থাৎ যে রিফর্মসগুলো (সংস্কার) জোরালোভাবে চালানো উচিৎ ছিল, সেটা করিনি। উল্টো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও খারাপ করেছে।”
নাজুক এই অর্থনীতিকে আবার তুলে আনা নতুন বছরে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই দেখা দিচ্ছে।
বিদায়ী বছরে পেঁয়াজ সঙ্কট, চামড়া নিয়ে হতাশা, ধানের দাম পড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে সরকারকে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের অবসান না ঘটলে তাও অর্থনীতিকে চাপমুক্ত করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে।
ডেঙ্গু এবছর মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড গড়ে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, নতুন বছরও পরিস্থিতি তেমন হলে সরকারের জন্য তা হবে নেতিবাচক।
বিদায়ী বছরে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনি কিংবা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের অভিজ্ঞতায় সরকারকে আরও কার্যকর ভূমিকায় দেখতে চায় দেশবাসী।
ক্রীড়াঙ্গনে নানা সাফল্য এলেও সবকিছু ম্লান হয়ে গেছে দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের জুয়াড়ীর সঙ্গে যোগাযোগে নিষিদ্ধ হওয়া।
রাজনৈতিক সহিংসতা কমলেও খুনসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দাবি। আলোড়ন তোলা কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ দ্রুত নেওয়া হলেও সাগর-রুনি, তানভীর ত্বকী, সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার এখনও শুরু না হওয়াও সরকারের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
বিদায়ী বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা অনেক বেড়েছে, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে অনেক শিশুও, যা মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে দেখেছেন সমাজ বিজ্ঞানী ও রাজনীতিকরা।
লুটপাটের অর্থনীতি সার্বিকভাবে দেশের উপর প্রভাব ফেলেছে বলে অভিমত সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের।
তিনি বলেন, “রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ। যতদিন আমাদের এখানে লুটপাটের অর্থনীতি বজায় থাকবে, আপনি সুস্থ ধারার রাজনীতিও পাবেন না, সুস্থ ধারার পরিবেশও পাবেন না। সব কিছুতে এখন বাণিজ্যিকীকরণ। আমাদের সমস্ত সমাজটাকে বদলাতে না পারলে এই থেকে উত্তরণ ঘটানো বেশ কঠিন বলে আমি মনে করি।”
ঢাকার কারওয়ান বাজারের চানাচুর বিক্রেতা কলিম উল্লাহ, গুলিস্তানের ফুটপাতে জুতা বিক্রেতা হানিফ সরকার কিংবা উত্তরাঞ্চলের ট্রাকচালক মমিন মিয়াও সন্তুষ্ট নন দেশের এই পরিস্থিতিতে। তাদের ভাষ্য, কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই।
রাষ্ট্রের সব কিছু যেহেতু রাজনীতি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, রাজনীতিকরাই যেহেতু রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক, সেহেতু দায় তাদের উপরই বর্তায়।
আওয়ামী লীগের একচেটিয়া আধিপত্যে রাজনীতির অঙ্গন অনেকটাই নিস্তরঙ্গ; বিদায়ী বছরে সম্মেলন করে দল ও সরকারকে আলাদা করার একটি প্রয়াস চালিয়েছে দলটি, যা রাষ্ট্র পরিচালনায় সুফল দেবে বলে মনে করছেন রাজনীতির বিশ্লেষকরা।
কিন্তু মূল সমস্যা কোথায়- সেই কথা ফুটে উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়। গণতন্ত্র কিংবা মত প্রকাশের অধিকার হরণের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদের পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতাই বড় সঙ্কট।
দেশের সুবর্ণ জয়ন্তি উদযাপনেও রাজনৈতিক দলগুলো একমঞ্চে আসতে পারছে না বলেই ইঙ্গিত মিলছে।
এই প্রেক্ষাপটে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মনে করেন, “রাজনৈতিক জীবনে, সামাজিক জীবনে এবং পারিবারিক জীবনে আরও অনেক সেতু দরকার। আমাদের ওয়াল (দেয়াল) হচ্ছে, ব্রিজ (সেতু) তৈরি হচ্ছে না।”
“আমাদের অনেকের মুখে মুখে ফরমালিনের মতো বিষ। এই অবস্থা থাকলে ওয়াল আরও উঁচুতে উঠবে, সম্পর্কের সেতু নির্মাণ হবে না। আমি সকলের কাছে অনুরোধ করব, আসুন পোলারাইজড পলিটিকস থেকে ফিরে আসি। আর ওয়াল নয়, আমাদের সেতু নির্মাণ করা দরকার,” বলেছেন তিনি।
সম্পর্কের এই ‘সেতু’ নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের দায়িত্বই প্রধান বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।