ফিরে দেখা ২০১৯: মশা ভয়ঙ্কর!

অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে সেখান থেকে সংসদে গেলেও বাজেট প্রস্তাব পুরো পড়তে পারলেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল; কিছু দিন পর সুস্থ হয়ে বললেন, শত্রুরও যেন ডেঙ্গু না হয়।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2019, 05:04 PM
Updated : 29 Dec 2019, 05:24 PM

ডেঙ্গুর ব্যাপকতায় ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও অসুস্থ সন্তানকে ভর্তি করতে পারেননি অনেক বাবা-মা।

বড় দুঃসময়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পিআইসিইউ-এর একটা সিট মেলাতে না পারায় প্রাণ গেছে একটি ছোট্ট মেয়ের, যদিও তার চিকিৎসার জন্য বাবা-মায়ের টাকার অভাব ছিল না।

বছরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর ভয়ঙ্করী বিস্তারের মধ্যে স্বামী-সন্তান নিয়ে দেশে বেড়াতে এসে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ইতালি প্রবাসী এক নারী।

ঢাকায় ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন নওগাঁর এক বৃদ্ধ দম্পতি। জ্বর হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই মারা যান বাবা, তাকে হারানোর শোক না কাটতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে যেতে হয় মাকে।

তাদের মতো কেউ স্বজনকে দেখতে এসে, কেউ আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসে আবার কেউ একদিনের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে এসেও ডেঙ্গুর জীবাণু শরীরে নিয়ে যান।

ডেঙ্গুর চাপে সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি হয় ধারণ ক্ষমতার কয়েক গুণ, ওয়ার্ডগুলোর মেঝে ছাপিয়ে বারান্দা এমনকি লিফটের সামনের খোলা জায়গায়ও কোনো রকম বিছানা ফেলে চিকিৎসা নিতে হয়।

অনেক অপেক্ষা ও অনুরোধের পরেও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে চিকিৎসার জন্যই অনেককে ছুটতে হয়েছে ঢাকার বাইরে।

এই যখন পরিস্থিতি সে সময় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস ইজিপ্টি মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা না থাকার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে সৃষ্টি হয় আরেক আলোচনা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কেউ কেউ বর্ষা মওসুমের প্রথম দিকেই ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক করলেও তাতে গুরুত্ব না দিয়ে এই রোগের বিষয়ে নগরবাসীকে অভয় দেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মো. সাঈদ খোকন। প্রথম দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপের খবরকে ‘গুজব’ বলেও উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি, যার জন্য ব্যাপক সমালোচনায় পড়তে হয় তাকে।

ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে ঢাকার শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীদের ভিড়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পরে নানামুখী চাপে প্রকৃত অবস্থা স্বীকার করে নিয়ে নতুন ওষুধ আমদানির পাশাপাশি দিনে দুই বেলা ওষুধ ছিটানো এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে এইডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনে দুই সিটি করপোরেশন।

তবে এর মধ্যে এই রোগ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ায় আগামী বর্ষা মওসুম নিয়ে শঙ্কায় আছেন মানুষ।

আক্রান্তে রেকর্ড

আক্রান্ত কিংবা মৃতের সংখ্যা বা রোগের ভয়াবহতা, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু এসেছে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙতে। একইসঙ্গে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়েছে ৬৪ জেলায়।

এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। আর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৪৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, যদিও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে আড়াইশ’র বেশি মানুষের এই রোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার হিসেবে এ বছরের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ৯৩৩ জন। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে আসা ২৬৬টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে ১৪৮ জনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে তারা।

এর আগে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ২০০০ সালে, ৯৩ জন। ওই বছরই রোগটি প্রথম ভয়াবহ আকার নেয়, আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৫৫১ জন।

জ্বর নিয়ে ঢাকার শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা এক শিশুর রক্ত নেওয়া হয় ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এরপর ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ও এতে মৃত্যু কমে আসে। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বছরে আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের নিচে থাকে, মৃতের সংখ্যাও ছিল খুব কম। ২০১৬ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়ালেও পরের বছর আবার কমে যায়। এরপর আবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে ২০১৮ সালে, ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়ে ২৬ জন মারা যায়। আর এ বছরে প্রাদুর্ভাব বেড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ডের জন্ম দেয়।

২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ১৪৮ জনের ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে সরকারের খাতায়। সেখানে এ বছরের অগাস্টেই আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন।

শহর-গ্রামে সমান আক্রান্ত

বিগত বছরগুলোয় ডেঙ্গু ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও এ বছর ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে সারা দেশে। এবার গ্রামাঞ্চলেও পাওয়া গেছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশা।

 

এরমধ্যে ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫১ হাজার ৭৬২ জন, রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন জেলায় রোগী পাওয়া গেছে প্রায় সমপরিমাণ, ৪৯ হাজার ৫১১ জন।

ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে খুলনা বিভাগে ১১ হাজার ৯৭১ জন, সবচেয়ে কম সিলেটে ১ হাজার ১১ জন।

দুই মেয়র দুই মেরুতে

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে আইসিডিসিআর,বির একটি গবেষণা প্রতিবেদন নতুন করে উত্তাপ ছড়ায়। তাদের গবেষণায় বলা হয়, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস ইজিপ্টি মশা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। সে কারণে দুই সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটাচ্ছে, তা কোনো কাজে আসছে না।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা মশা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এই পতঙ্গের ওষুধ প্রতিরোধের সক্ষমতার প্রমাণ পায়।

ইউএস সিডিসির অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণায় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে এইডিস ইজিপ্টি ও কিউলেক্স মশার ডিম সংগ্রহ করে আইসিডিডিআর,বির গবেষণাগারে বড় করা হয়।

এ বছরের মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের একটি সভায় দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।

মশার ওষুধ নিয়ে দুই মেয়র দুই অবস্থান নেন। মশা মারার ওষুধ অকার্যকর হওয়ার প্রমাণ পেয়ে ওষুধ বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে কার্যকর ওষুধ আমদানির ঘোষণা দেয় তারা। ওষুধের মাত্রা দ্বিগুণ করারও ঘোষণা আসে উত্তর সিটি থেকে।

অন্যদিকে ওষুধ ‘অকার্যকর’ মানতে নারাজ ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হন।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ সেই সময় গত ৪ অগাস্ট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আয়োজনে তৌফিক ইমরোজ খালিদী লাইভে এসে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ওই দিন দুপুরেও পরীক্ষায় ওষুধের কার্যকারিতার ‘প্রমাণ পেয়েছেন’।

 

তিনি বলেছিলেন, “অকার্যকর ওষুধ নিয়ে আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে আমার দ্বিমত ছিল। যে ওষুধ এখন আমরা ব্যবহার করি সেটা ৯৯ দশমিক ৪০ শতাংশ কেরোসিনের সঙ্গে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পারমেথ্রিন, শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টেট্রামেথ্রিন এবং শূন্য দশমিক ২ শতাংশ অ্যালেথ্রিন।

আইসিডিডিআর,বি পারমেথ্রিনকে অকার্যকর বলেছে। এটা হচ্ছে কিলিং এজেন্ট। আমি বলেছি, এই ওষুধের একটা অংশ অকার্যকর। পুরোপুরি অকার্যকর নয়।”

ওই আলোচনায় ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, পূর্ণ বয়স্ক এইডিস মশার ওপর ওষুধের পরীক্ষায় ভালো ফল পাননি তিনি।

“আমরা আমদানিকারকের কাছ থেকে ওষুধটা নিয়ে এসেছিলাম। মশারির ভেতর মশা রেখে ওষুধটা প্রয়োগ করেছি। দেখেছি মশা ‘নক ডাউন’ করে নাই। এটা ছয় মাস আগের কথা। আমরা ওই কোম্পানির কাছ থেকে ওষুধ নেওয়া বাদ দিয়েছি। পরে অন্য একটা কোম্পানি থেকে ওষুধ নিয়ে দেখেছি, সেটা এখন কার্যকর আছে।”

কার্যকারিতা বাড়াতে মশার ওষুধের মাত্রাও দ্বিগুণ করে ডিএনসিসি।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে এইডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে বাড়ি বাড়ি অভিযান চালায় দুই সিটি করপোরেশন। বিভিন্ন বাড়ি-প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের জরিমানাও করা হয়। শহরজুড়ে চালানো হয় ডেঙ্গু বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রচারণা।

‘প্রয়োজনে প্লেনে করে’ মশার ওষুধ আনার ঘোষনা দেন মেয়র খোকন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও।

মশা মারতে আদালতের রুল

এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতকেও হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও এইডিস মশা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আসার পর আদালত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয়।

হাসপাতালগুলোতে যখন ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছে সেই সময় ২ জুলাই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে উচ্চ আদালত। সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে।

ডেঙ্গুর ‘মহামারির আকার’ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের উদ্দেশে আদালত বলে, বিচার বিভাগেরও অনেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত। শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।

“আপনারা কী ওষুধ দিচ্ছেন? তাতে তো নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।”

এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং সেগুলোর কার্যকারিতা কী তা নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে দুই সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেয় আদালত।

১২ জুলাই স্ত্রী ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে উকিল নোটিশ পাঠান একজন আইনজীবী। পরদিন ফল নিয়ে সেই রোগীকে দেখতে যান মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়লে ১৪ জুলাই এইডিস মশা ধ্বংসে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। ১৭ জুলাই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টিসহ মশা নিয়ন্ত্রণ বা নিধনে অকার্যকর ওষুধ আমদানি, সরবরাহ ও কেনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেয় আদালত।

পরে ২২ জুলাই ঢাকা মহানগরীতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের বিস্তার রোধে মশা নির্মূলে দুই সিটি করপোরেশনের নেওয়া পদক্ষেপে অসন্তোষ প্রকাশ করে হাই কোর্ট। সেদিন বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর হাই কোর্ট বেঞ্চ মশা নির্মূল কার্যক্রম সম্পর্কে জানাতে দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে হাই কোর্টে তলব করেন।

ওই দিন পরিস্থিতি নিয়ে আক্ষেপ করে একজন বিচারক বলেন, “পৃথিবীর আর কোনো দেশে মশা মারতে আদালতকে রুল দিতে হয় না।”

আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় মশা নিধনে ‘ওষুধ কাজ না করার’ বিষয়টি সামনে আসার পর এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে নতুন কার্যকর ওষুধ আনতে তাগাদা দেয় উচ্চ আদালত।

শয্যা খালি নেই, মুগদা হাসপাতালে বহু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় বারান্দায় রেখে

মশা মরার ওষুধ কে আমদানি করবে, তা নিয়েও স্থানীয় সরকার বিভাগ আর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হয়। ১ অগাস্ট হাই কোর্টের শুনানিতে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসে। এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে দুপুর ২টার মধ্যে মধ্যে আদালতে তলব করেন বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর হাই কোর্ট বেঞ্চ।

সেদিন হাই কোর্টে হাজির হন হেলালুদ্দিন আহমদ। তিন দফা শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেয়, বিদেশ থেকে ওষুধ আনতে হবে দুই সিটি করপোরেশনকেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ মশা মারার ওষুধ দ্রুত আনতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ‘লাইসেন্স’ ও ‘ক্লিয়ারেন্স’সহ সার্বিক সহযোগিতা দেবে।

আগামী বছর যাতে এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও তাগাদা দিয়েছে হাই কোর্ট।

বছরজুড়ে এইডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনো কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে কি না, গত ২০ অগাস্ট তা জানতে চায় হাই কোর্ট। বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।

বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক বলেন, “এ বছর মশার প্রকোপ দেখা দিয়েছে, সেটা যে আগামীতে যে হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এজন্য মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। পাশের দেশ ভারতের কলকাতায় যেমনটা রয়েছে। তারা মশা নিধনে এরিয়াল স্প্রে করে থাকে।”

ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এইডিস মশা নিয়ে গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। এই কীটতত্ত্ববিদের মতে, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে খারাপ বছর’ ছিল। তিনি বলেন, এবারই গ্রামে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে এবং এটাই সবচেয়ে আতঙ্কের।

“এইডিস ইজিপ্টি ডেঙ্গুর প্রধান বাহক, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে আমরা এইডিস ইজিপ্টি মশা পাইনি। কিন্তু এ বছর গ্রামে ডেঙ্গু হল। তার মানে গ্রামে এইডিস অ্যালবোপিক্টাস মশাটা ওই রোগ ছড়ানোয় ভূমিকা রাখছে।

“শহরাঞ্চলে সিটি করপোরেশনকে দায়ী করতে পারলেও বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ইউনিয়ন পরিষদগুলোর দক্ষতা, প্রশিক্ষণ কোনোটাই নেই। এছাড়া গ্রামের মানুষ এতটা সচেতনও নয়। আগামী বছরও যদি গ্রামে ডেঙ্গু হয় তাহলে এটা ম্যানেজ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।”

আসছে বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দেন অধ্যাপক কবিরুল বাশার।

তিনি বলেন, মশক নিধনের জন্য একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান হওয়া জরুরি।

“কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই। আর ডেঙ্গুর ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে মশক নিয়ন্ত্রণে কী কী ব্যবস্থা আগামী বছর নিতে হবে, কী ধরনের কীটনাশক আনবে পরীক্ষার মাধ্যমে সেটা আগেই নির্ধারণ করবে। আর সারা দেশের জন্য সরকারি সবগুলো প্রতিষ্ঠানের জন্য একই কীটনাশক একই সরকারি প্রতিষ্ঠান আমদানি করে বিভিন্ন দপ্তরে বিতরণ করবে।”