২০১৯: গুজব আর ক্যাসিনোকাণ্ডের বছর

আগের বছর শুরু হওয়া মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ২০১৯ সালেও শেষ হয়নি; থামেনি কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর মিছিল। গুজবের জেরে পিটিয়ে হত্যার একের পর এক ঘটনা আতঙ্ক জাগিয়েছে এ বছর। নুসরাত জাহান রাফি, রিফাত শরিফ ও আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়ে গেছে বাংলাদেশকে। আর বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটিয়ে গেছে ক্যাসিনোকাণ্ড।

লিটন হায়দারও কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2019, 04:24 PM
Updated : 30 Dec 2019, 04:24 PM

ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের ভেতর ছিল জুয়ার সব আয়োজন। ছবি:আব্দুল্লাহ আল মমীন

জুয়ার রাজ্যে তোলপাড়

মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় অবৈধভাবে চালানো ক্যাসিনো বন্ধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান ছিল বিদায়ী বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। আর এসব ক্যাসিনোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সম্পৃক্ততার কারণে ক্যাসিনো বন্ধের অভিযান সরকারি দলের নেতাদের ভাষায় হয়ে ওঠে শুদ্ধি অভিযান। সেই অভিযান রাজনীতির অঙ্গনেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়।

১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবের মধ্য দিয়ে অভিযানের শুরু। এরপর মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স , ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব এবং কলাবাগান ক্রীড়াচক্রে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান‌ চালায় র‌্যাব- পুলিশ। এসব অভিযানে গ্রেপ্তার হন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, শফিকুল আলম ফিরোজ, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজিব ও ময়নুল হক মঞ্জু এবং ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া।

ক্যাসিনোকাণ্ডের মধ্যেই নিজের অফিস থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ গ্রেপ্তার হন যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা চালিয়ে আসা জিকে শামীম। অনলাইন ক্যাসিনোর কারাবারে সম্পৃক্ততায় গ্রেপ্তার হন ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান। গেণ্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূইয়ার বাড়িতে অভিযানে পাওয়া যায় কয়েকটি সিন্দুক বোঝাই টাকা ও গয়না, যার উৎস ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো।

ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত ফকিরাপুল-মতিঝিল এলাকার কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ অভিযান শুরুর আগেই বিদেশে চলে যান। তাকেও দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ঢাকার কাউন্সিলরদের মধ্যে আরও বেশ কয়েকজন অভিযান শুরুর পর থেকে লাপাত্তা।

ছেলেধরা সন্দেহে ঢাকার বাড্ডায় এক নারীকে পিটিয়ে হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন হৃদয়কে গ্রেপ্তারের পর বুধবার ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে আনা হয়।

গুজব এবং পিটিয়ে হত্যা

‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে’- এমন এক গুজব ছড়ানো হয় বছরের মাঝামাঝি সময়ে।  সেই মাথার জন্য শিশুদের চুরি করে নেওয়া হচ্ছে – এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে জনমনে তৈরি হয় আতঙ্ক। জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার খবর আসতে থাকে। ১৮ জুলাই নেত্রকোনার নিউ টাউন হরিজন পল্লী এলাকায় এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী, পরে তার ব্যাগে পাওয়া যায় এক শিশুর মাথা। পরে পুলিশ জানায়, ওই যুবক মানসিক ভারসম্যহীন ছিল।

মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সাভার ও কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হন দুজন। লালমনিরহাটে মানসিক প্রতিবন্ধী তিনজন গণপিটুনির শিকার হন। তিনজন আহত হন পাবনাতেও। কুমিল্লায় এক নারীসহ চারজন, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে ছয়জন গুজবের কারণে পিটুনির শিকার হন। রাজশাহীতে একটি স্কুলের সামনে এক চিপস কোম্পানির তিন কর্মী নিছক সন্দেহ থেকে জনতার রোষে পড়েন। নওগাঁর মান্দায় পিটিয়ে আহত করা হয় এক জেলেকে।

২০ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রেনু নামে এক নারীকে ছেলে ধরা সন্দেহে স্কুলের সামনে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ওই গুজবে বিভ্রান্ত না হতে প্রসনোট দিতে হয় সরকারকে। পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় কয়েক ডজন মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। জুলাইয়ের শেষ দিনে পালন করা হয় ‘গুজবের বিরুদ্ধে সচেতনতা সপ্তাহ’।

নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি শুক্রবার জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে কয়েকটি সংগঠন।

ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ড

অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনা নাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশকে। স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে। তদন্তভার নিয়ে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই।

বিচার শেষে গত ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আসামিদের সবার ফাঁসির রায় দেয়। অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকেও আট বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল।

বরগুনার রিফাত শরিফ হত্যাকাণ্ড

বরগুনা শহরের কলেজ রোডে গত ২৬ জুন রিফাত শারিফকে দিনে দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে। সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ধরা পড়েন তার প্রধান সহযোগী রিফাত ফরাজীসহ কয়েকজন। নিহত রিফাতের বাবা ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় যে হত্যা মামলা দায়ের করেন, তাতে মিন্নিকে ১ নম্বর সাক্ষী করা হয়।

কিন্তু রিফাতের বাবাই পরে এ হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন। মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনায় তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। নানা নাটকীয়তার মধ্যে মিন্নিসহ ২৪ জনকে আসামি করে ১ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। আগামী ১ জানুয়ারি এ মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ রয়েছে।

আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে শনিবার বুয়েটের সামনের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড

বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ৬ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করে একদল ছাত্রলীগ কর্মী। শিবির সন্দেহে ডেকে নিয়ে আবরারকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সেই বিবরণ হতবাক করে দেয় পুরো দেশকে। বুয়েটে র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন যে নিয়মিত ঘটনা ছিল, সে বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসে এরপর।

ওই ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বুয়েটে। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। দ্রুযত তদন্ত শেষ করে ছাত্রলীগের ২৫ জনকে আসামি করে ১৩ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে মামলার আসামি এবং বিভিন্ন সময়ে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ ওঠা ৫২ জনকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করা হয়। কর্তৃপক্ষ সব দাবি মেনে নেওয়ায় দুই মাস পর ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দেয় বুয়েট শিক্ষার্থীরা।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নাঈমুল আবরার রাহাতের মৃত্যুর ঘটনায় কিশোর আলো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে বুধবার ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের সামনে সাবেক শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

আরেক আবরারের মৃত্যু

নভেম্বর মাসের শুরুর দিন ঢাকার মোহাম্মদপুর রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে দৈনিক প্রথম আলোর সাময়িকী কিশোর আলোর একটি অনুষ্ঠান চলাকালে নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরার রাহাতের (১৫) মৃত্যুর ঘটনাও আলোচনার জন্ম দেয়। অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর কাছে সোহরোওয়ার্দী হাসপাতালে না নিয়ে আবরারকে কেন মহাখালীর একটি হাসপাতালে কেনো নেওয়া হয়েছিল- সেই প্রশ্ন উঠে। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ায়, বিচারকের নির্দেশে কবর থেকে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত হয় ওই স্কুলছাত্রের। 

চীনা নাগরিক খুন

বছরের শেষ দিকে এসে ১১ ডিসেম্বর বনানীতে গাউজিয়ান হুই নামে এক চীনা নাগরিকের লাশ উদ্ধারের ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।  যে বাড়িতে ওই বিদেশি ভাড়া থাকতেন, তার পাশে খোলা জায়গায় মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল তার লাশ। তদন্তে নেমে পুলিশ শুরুতে হিমশিম খায়। পরে দুই নিরাপত্তাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলে হত্যা রহস্যের কিনারা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, টাকার লোভে ওই চীনা ব্যবসায়ীকে খুন করে দুই নিরাপত্তাকর্মী।

শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার ‘হত্যার’ বিচারের দাবিতে শনিবার ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পুলিশকন্যা রুম্পার মৃত্যু

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার মৃত্যু এ বছরের আরেকটি আলোচিত ঘটনা। গত ৪ ডিসেম্বর মালিবাগের শান্তিবাগের বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের এক গলিতে রুম্পার লাশ পাওয়া যায়। উপর থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার জানালেও এটা হত্যা না আত্মহত্যার ঘনা- সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনও।

সাম্প্রদায়িক উসকানি, সংঘাত

অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ভোলার বোরহানউদ্দিনে এক হিন্দু তরুণের ফেইসবুক আইডি ‘হ্যাক করে অবমাননাকর’ বক্তব্য ছড়ানো হয়। সেই বক্তব্য দেখিয়ে উসকে দেওয়া হয় মানুষকে। সেই তরুণের শাস্তি দাবিতে ২০ অক্টোবর ‘মুসলিম তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে ডাকা হয় সমাবেশ। সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যে গুলিতে নিহত হন চারজন। সেই উত্তেজনার রেশ চলে মাসজুড়ে। যার ফেইসবুক ’হ্যাক করে’ মেসেঞ্জারে কথিত ধর্ম অবমাননাকর বক্তব্য ছড়ানো হয়েছিল, সেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য শুভকেও গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটকে রেখেছে পুলিশ।

প্রতিদিন গড়ে ১ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে কয়েকশ মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের শুরুতে বড় খবর হয়ে এসেছিল শতাধিক মাদক কারবারির আত্মসমর্পণ। কিন্তু মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধ আর তাদের মৃত্যুর মিছিল থামেনি। সংবাদপত্রে আসা তথ্যের ভিত্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সে অনুযায়ী বছরের প্রথম ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে অথবা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৩৫ জন।

সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে অন্তত একজনের মৃত্যু হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। তবে তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন মাদক চোরাকারবারি কতজন, সে তথ্য আলাদাভাবে তারা হিসাব করেনি। এর আগে ২০১৮ সালে পুরো বছরে র‌্যাব, পুলিশ আর বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৪১২ জন নিহত হওয়ার পরিসংখ্যান দিয়েছিল আসক।

র‌্যাবের মিডিয়া উইং জানিয়েছে, এ বছর ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদক সংক্রান্ত অপরাধে  ৯ হাজার ৯৩৫ জনকে তারা গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে প্রায় ৪৫কেজি হোরোইন, ৭৬ লাখ ইয়াবা, একলাখ ৮১ হাজার বোতল ফেনসিডিল এবং গাঁজা, কোকেন ও মদ উদ্ধার করা হয়েছে। আগে বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে মাসভিত্তিক অপরাধ পরিসংখ্যান দেওয়া হলেও সম্প্রতি তা তুলে ফেলা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরে অপরাধের পরিসংখ্যান চাওয়া হলে তা পাওয়া যায়নি।

হারকিউলিস

বছরের ধর্ষণ মামলার কয়েকজন আসামির গলায় ‘স্বীকারোক্তির’ চিরকুট বাঁধা লাশ উদ্ধারের ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও আলোচনার জন্ম দেয়। বছরের শুরুতে ঝালকাঠি ও আশুলিয়ায় এরকম তিনজনের লাশ পাওয়া যায়, যাদের গলায় চিরকুট ছিল। তাতে লেখা ছিল এটাই ধর্ষকের পরিণতি- হারকিউলিস।

কথিত বন্দুকযুদ্ধের গল্পে হারকিউলিসের চিরকুট খানিকটা নতুনত্ব আনলেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার মধ্যে পৌরানিক গ্রীক বীরের অন্তর্ধান ঘটে। তবে এরপর ঢাকার সাভার, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ময়মনসিংহের ভালুকা, চট্টগ্রামের পটিয়া এবং ভোলা সদরে ধর্ষণে সন্দেহভাজন অন্তত ছয়জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

জঙ্গি নিশানায় পুলিশ

গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গিরা কোনঠাসা হয়ে পড়লেও এবছর পুলিশকে লক্ষ্য  করে ছোটখাটো কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা হয়। ২৬ মে বোমা মারা হয় মালিবাগে এসবি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে। ২৩ জুলাই খামারবাড়ি ও পল্টনে পুলিশ বক্সের সামনে দুটি প্যাকেটে বোমা পাওয়া যায়। এরপর গত ৩১ অগাস্ট সাইন্সল্যাবে পুলিশ বক্সের সামমে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যার লক্ষ ছিল পুলিশ।

প্রতিটি ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের পক্ষ থেকে হামলার দায় স্বীকারের খবর গণমাধ্যমে আসে। তবে ২২ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে মিশুক খান মিজান ও ফরিদ উদ্দিন রুমি নামের নব্য জেএমবির দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারাই ছিল পুলিশের ওপর হামলার পেছনে। এরপর অক্টোবরে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আরও দুইজনকে গ্রেপ্তার করে বলা হয়, গুলিস্তান ও সায়েন্সল্যাবের হামলায় তারা জড়িত ছিল।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবকিছু মিলিয়ে আমরা মনে করি, জঙ্গিদের অপারেশনাল ক্যাপাসিটি ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অতি দুর্বল করা সম্ভব হয়েছে। তবে এরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমাদের কার্যক্রমও অব্যাহত থাকবে। সংগঠিত হয়ে কিছু করার আগেই তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারব; সেই প্রত্যয় আমাদের রয়েছে।”

পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির

পুলিশ বনাম দুদক

পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ছিলেন বিদায়ী বছরের অন্যতম আলোচিত চরিত্র। ডিঅইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের তথ্য অনুসন্ধানে ছিলেন দুদকের বাছির। এর মধ্যে বাছিরকে ৪০লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন দাবি করে টেলি আলাপের একটি অডিও সংবাদমাধ্যমকে দেন পুলিশ কর্মকর্তা মিজান। পরে তাদের দুজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়, দায়ের করা হয় মামলা।  তদন্তের মাধ্যমে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুদক থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন এনামুল বাছির।