বিদায়ী বছরে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু হয়ে উঠেছে মাথাব্যথার বড় কারণ। মশার এই চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের মানুষ আর সরকারকে সামলাতে হবে নতুন বছরেও।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দুর্বলতা এ বছর দেখিয়ে দিয়েছে পেঁয়াজ। চুড়িহাট্টা আর এফআর টাওয়ারের আগুন বলে গেছে নজরদারির দুর্বলতার কথা। আর গুজব চিনিয়েছে সচেতনতার ফুটো।
উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারীদের গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে সাতজনকে হত্যার ঘটনা বিমুঢ় করেছে পুরো দেশকে। বছরের বিভিন্ন সময়ে আরও কয়েকটি হত্যার বর্বরতা জাতিকে নাড়া দিয়ে গেছে।
বিমান ছিনতাইয়ের নাটকীয়তার জন্ম দিয়ে বছরের শুরুতে কমান্ডো অভিযানে প্রাণ গেছে এক তরুণের, যিনি ছিলেন এক চিত্রনায়িকার সাবেক স্বামী। রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পর তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসার ঘটনা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কোরবানির ঈদের পর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ কাঁচা চামড়া ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ছিল এবারের বড় খবর।
ক্যাসিনোকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে জিহাদ বিদায়ী বছরে শুরু হয়েছে, তার ফলাফল দেখার অপেক্ষা থাকবে ২০২০ সালে।
নতুন বছরের কাছে প্রশ্ন থাকবে- কবে হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন?
ডেঙ্গুতে নাকাল
২০১৯ সালে রেকর্ড সংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে পাঠিয়ে, এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে বড় ধরনের নাড়া দিয়ে গেছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু।
এ বছর ডেঙ্গুর লক্ষণ ও উপসর্গগুলো ছিল অন্য বছরের তুলনায় খানিকটা আলাদা। ফলে চিকিৎসকরা শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। কিন্তু ঘরে ঘরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় আতঙ্ক। সামান্য জ্বরেই মানুষ রক্ত পরীক্ষার জন্য ভিড় করতে থাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে। হাসপাতালে রোগী সামাল দিতে রাত দিন পরিশ্রম করে যেতে হয় চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের।
মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েন ঢাকার দুই মেয়র। মশার ওষুধ কেনার বিষয়টি গড়ায় আদালতে। এ নিয়ে আক্ষেপ করে হাই কোর্টের একজন বিচারক বলেন, পৃথিবীর আর কোনো দেশে মশা মারতে আদালতকে রুল দিতে হয় না।
পরিস্থিতি সামাল দিতে লন্ডনে সফররত প্রধানমন্ত্রী ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে সক্রিয় হওয়ার এবং মশার বংশ বিস্তার রোধে বাড়ি, কর্মস্থল ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখার আহ্বান জানান। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও দুই বেলা ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়।
বর্ষা মওসুম শেষে ডেঙ্গুর মওসুমও শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করা হাচ্ছিল। কিন্তু ঢাকা থেকে ডেঙ্গু এবার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ায় এখনও প্রতিদিন বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এখন দুই রকমের মশা ডেঙ্গুর বাহক হিসেবে কাজ করছে বলে আগামী তে সারা বছরই কম বেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইডিসিসিআরের পরিচালক ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, “দেশজুড়ে ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকাতে স্বাস্থ্য বিভাগের চেয়ে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিৎ বেশি।… যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আগামী সিজন আসার আগেই আমরা যত বেশি কাজ করত পারব, তত ভালো। বছর জুড়ে কার্যক্রমে ঢিলে দেওয়ার কোনো উপায় নেই।”
ক্যাসিনো আবিষ্কার
দেশের বিভিন্ন ক্লাবে অবৈধভাবে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। এ নিয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে। তবে বাংলাদেশেও যে স্লট মেশিন, রুলেট টেবিলের মত সরঞ্জাম নিয়ে পুরোদত্তর ক্যাসিনো চলে, সেই আবিষ্কার ছিল ২০১৯ সালের অন্যতম সাড়া ফেলা ঘটনা।
আর এসব ক্যাসিনোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সম্পৃক্ততার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনো বন্ধের অভিযান সরকারি দলের নেতাদের ভাষায় হয়ে ওঠে শুদ্ধি অভিযান। সেই অভিযান রাজনীতির অঙ্গনেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে র্যাবের প্রথম অভিযানের দিন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক ওই ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর একে একে গ্রেপ্তার হন কলাবাগার ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, মোহাম্মদপুরের আলোচিত ওয়ার্ড কাউন্সর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজিব, পুরান ঢাকার কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু।
ক্যাসিনোকাণ্ডের মধ্যেই নিজের অফিস থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ গ্রেপ্তার হন যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা চালিয়ে আসা জিকে শামীম। অনলাইন ক্যাসিনোর কারাবারে সম্পৃক্ততায় গ্রেপ্তার হন ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান। গেণ্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূইয়ার বাড়িতে অভিযানে পাওয়া যায় কয়েকটি সিন্দুক বোঝাই টাকা ও গয়না, যার উৎস ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো।
ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত ফকিরাপুল-মতিঝিল এলাকার কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ অভিযান শুরুর আগেই বিদেশে চলে যান। তাকেও দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ঢাকার কাউন্সিলরদের মধ্যে আরও বেশ কয়েকজন অভিযান শুরুর পর থেকে লাপাত্তা।
চলমান শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, “আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জুয়াসহ সব সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে।”
পেঁয়াজের এত ঝাঁজ
বৃষ্টি আর বন্যায় এবার পেঁয়াজের ফলন মার খাওয়ায় ভারত সরকার হঠাৎ করেই রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে পুরো উপমহাদেশজুড়ে হেঁসেলে হেঁসেলে নেমে আসে দুঃস্বপ্ন। প্রতিদিনের রান্নায় বহুল ব্যবহৃত এই সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের বাজারে আড়াইশ টাকায় পৌঁছায়, যার নজির অতিতে আর নেই।
প্রথমে ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি মূল্য দ্বিগুণ করে প্রতি টনের ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করলে বাংলাদেশে দাম এক দফা বাড়ে। পরে ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। তাতে দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতাদের মনে তৈরি হয় উদ্বেগ, বাজারে তৈরি হয় অস্থিরতা।
অক্টোবরের শেষ দিকে সরকার মিয়ানমার থেকে আমদানি বাড়িয়ে দাম একশ টাকার কাছাকাছি নিয়ে এলেও নভেম্বরের ৯ তারিখ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে বাজার নিয়ন্ত্রণের সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে পেঁয়াজের দাম পৌঁছে যায় আড়াইশ টাকায়।
দুই মাস ধরে বাজারে এই অস্থিরতার কারণে পাড়া-মহল্লার অনেক দোকানি পেঁয়াজ রাখাই বন্ধ করে দেন। রেস্তোরাঁগুলোও পেঁয়াজ কেনা কমিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষও রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার কমাতে বাধ্য হয়। অক্টোবরে ভারত সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে হিন্দি ভাষায় বলেন, “পেঁয়াজ মে থোড়া দিক্কত হো গিয়া হামারে লিয়ে। মুঝে মালুম নেহি, কিউ আপনে পেঁয়াজ বন্ধ কর দিয়া! ম্যায়নে কুক কো বোল দিয়া, আব সে খানা মে পেঁয়াজ বন্ধ কারদো।”
বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির পর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসতে শুরু করলে কমতে শুরু করে দাম। বছরের শেষে এসে উৎস দেশভেদে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৭০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেল- সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, “পেঁয়াজের বাজারে কারসাজির জন্য সরকারকে কিছু জেলজরিমানা করতে দেখা গেছে। কিন্তু যেহেতু সরকারের ওপর ব্যবসায়ীদের একটা প্রভাব রয়েছে; তাই প্রকৃত ব্যক্তিরা পার পেয়ে গেছেন বলে মনে হয়। শাস্তির মুখে পড়েছেন মাঝারি পর্যায়ের কিছু ব্যবসায়ী। এ সঙ্কটের জন্য কিছু ব্যবসায়ীর দায় রয়েছে, আবার সরকারও তার দায় এড়াতে পারে না।”
হায় সাকিব!
বছরের শেষ দিকে এসে ক্রিকেটাররা হঠাৎ ধর্মঘট ডেকে বসলে দেশের ক্রিকেট গেল গেল বলে ওর ওঠে। বিসিবির সঙ্গে খেলোয়াড়দের বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই দিনের টানাপড়েনের অবসানও ঘটে। কিন্তু আরও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তদের জন্য।
ভারত সফরের প্রস্তুতির মধ্যে দুঃসংবাদ আসে- বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, দেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান নিষিদ্ধ হয়েছেন।
ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর তা গোপন করায় বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে ২৯ অক্টোবর দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে আইসিসি, যার মধ্যে এক বছরের শাস্তি দোষ স্বীকার করায় স্থগিত থাকবে।
এই শাস্তির ফলে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্রিকেটে মাঠে নামতে পারবেন না সাকিব। প্রথম এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটানোর সময়ে নতুন করে কোনো আইন না ভাঙলে পরবর্তী এক বছরের শাস্তি থেকে তিনি রেহাই পাবেন। কিন্তু আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আর তার খেলা হবে না।
শাস্তির ওই সিদ্ধান্তের পর বিসিবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের ভুল স্বীকার করে সবার সমর্থন চান সাকিব।
তিনি বলেন, "একটা জিনিস আমি বলতে চাই, যেভাবে আপনারা আমাকে সবসময় সহযোগিতা করে এসেছেন, বাংলাদেশের সব ক্রিকেট ভক্ত, সব মানুষ, বিসিবি, সরকার থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের সবাই আপনারা যেভাবে সমর্থন করে এসেছেন আমার ভালো এবং খারাপ সময়ে, আশা করি আপনাদের সেই সমর্থনটা থাকবে।"
হতবাক করা তিন খুন
প্রতি বছরের মত এবারও বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে। তবে ধরন আর উদ্দেশ্যের কারণে তিনটি ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশকে।
ফেনীর নুসরাত হত্যা: অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে এপ্রিলে পরীক্ষার হল থেকে ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের সাত মাসের মাথায় অধ্যক্ষসহ ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা থেকে এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নুসরাত। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা মামলা করার পর গত ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে অধ্যক্ষ সিরাজকে। কিন্তু মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে সিরাজের সহযোগীরা।
এরপর ৬ এপ্রিল পরীক্ষা শুরুর আগে পরীক্ষা কেন্দ্র সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নুসরাতকে কৌশলে ডেকে নিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে পাঁচ দিন সব যন্ত্রণা সহ্য করে ১০ এপ্রিল মারা যায় প্রতিবাদী মেয়েটি।
এক পর্যায়ে তদন্তভার আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। এজহারভুক্ত আট আসামির সঙ্গে আরও আটজনকে যুক্ত করে ১৬ জনকে আসামি করে ৫ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬ আসামির বিচার। ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে আসামিদের সবার ফাঁসির রায় আসে।
অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকেও আট বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
বরগুনার রিফাত হত্যা: বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শারিফকে হত্যা করা হয় ২৬ জুন। স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়।
সেই ভিডিওতে দেখা যায় দুই যুবক রামদা হাতে কোপাচ্ছে রিফাতকে; আর মিন্নি চেষ্টা করছেন তাদের থামাতে। জানা যায় ওই দুই যুবক হল সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন, যিনি নিজেকে জেমস বন্ড ভাবেন বলে নাম নিয়েছেন নয়ন বন্ড। অন্যজন তার সহযোগী রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী। বন্ড গ্রুপ নামে দল গড়ে বরগুনা শহরে ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছিলেন তারা।
এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে মামলায় ১ নম্বর সাক্ষী করা হয়। এরপর ২ জুলাই নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ধরা পড়েন রিফাত ফরাজীসহ কয়েকজন।
দেশজুড়ে আলোচনার মধ্যে উচ্চ আদালত ২৯ অগাস্ট মিন্নিকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্যাতন করে মিন্নির স্বীকারোক্তি আদায় করেছে পুলিশ।
মিন্নিসহ ২৪ জনকে আসামি করে ১ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এ মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন আর অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ১ জানুয়ারি তারিখ রেখেছে আদালত।
বুয়েটে আবরার হত্যা: বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ৬ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করে একদল ছাত্রলীগ কর্মী। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর ছাত্রলীগ ১১ জনকে বহিষ্কার করে।
শিবির সন্দেহে ডেকে নিয়ে আবরারকে যেভাবে কয়েক ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই বিবরণ হতবাক করে দেয় পুরো দেশকে। বুয়েটে র্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন যে নিয়মিত ঘটনা ছিল, সে বিষয়টিও প্রকাশ্যে আসে এরপর।
এ ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠে বুয়েট ক্যাম্পাসে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শিক্ষার্থীরাই জড়িতদের চিহ্নিত করে। আন্দোলনের মধ্যে তোপের মুখে পড়েন বুয়েট উপাচার্য। পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়।
আবরার হত্যা মামলায় ২৫ জনকে আসামি করে ১৩ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। সেখানে বলা হয়, শিবির হিসেবে সন্দেহের বিষয়টি ছিল আবরারের ওপর নির্যাতনের ‘একটি কারণ’। আসলে বুয়েট ছাত্রলীগের ওই নেতাকর্মীরা অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত’ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর হত্যায় জড়িত আসামিসহ ২৬ শিক্ষার্থীকে বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। আরও ২৬ জনকে বহিষ্কার করা হয় বিভিন্ন সময় র্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করার অভিযোগে। কর্তৃপক্ষ সব দাবি মেনে নেওয়ায় দুই মাস পর ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দেয় বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, আবরার হত্যা মামলার বিচার হবে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে। সেখানে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না গেলে আরও ৪৫ দিন সময় নিতে পারে আদালত।
চুড়িহাট্টা নরককুণ্ড
এ বছর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর বহুতল ভবন ফারুক-রূপায়ন টাওয়ার, কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্লাস্টিক কারখানা এবং গাজীপুরে একটি ফ্যান কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ঝরে গেছে শতাধিক মানুষের প্রাণ।
এর মধ্যে কেবল চুড়িহাট্টাতেই ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম সরাতে নতুন করে উদ্যোগী হতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশে ওয়াহেদ ম্যানশনে বিকট বিস্ফোরণের পর বড় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন। সামনের রাস্তায় থাকা মানুষ আর যানবাহন পুড়ে খাক হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেই আগুন নেভায় দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টার চেষ্টায়।
শুরুতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও পরে তদন্তে জানা যায়, আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকে। ওই ভবনে বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি ছিল রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও প্রসাধন সামগ্রীর গুদাম। দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৩৬ দিনের মাথায় ২৮ মার্চ আগুনে পোড়ে অভিজাত এলাকা বনানীর বহুতল ভবন এফ-আর টাওয়ার। শ্রীলঙ্কার এক নাগরিক এবং ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীসহ ২৬ জনের প্রাণ যায়।
ওই ঘটনার পর এফ-আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতির তথ্য বেরিয়ে আসে। ভবন মালিকদের পাশাপাশি রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে রাজধানীতে ভবনে ভবনে শুরু হয় রাজউকের অভিযান।
বছরের শেষ দিকে এসে ১১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় আগুন লেগে ২২ জনের মৃত্যু হয়। ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুরে লাক্সারি ফ্যান কারখানায় ভয়াবহ আগুনে মৃত্যু হয় ১০ জনের। ওই দুই কারখানার কোনোটিরই অনুমোদন ছিল না।
ডাকসুতে নূরের চমক, অস্থিরতা ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু প্রায় তিন দশক পর সচল হয়েছে এ বছর; কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন-অস্থিরতার খবর বিদায়ী বছরে বার বার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।
নানা অভিযোগ আর অধিকাংশ প্যানেলের প্রার্থীদের বর্জনের মধ্যে গত ১১ মার্চ ডাকসু ও ১৮টি হল সংসদের নির্বাচন হয়। ডাকসুর ২৫টি পদের মধ্যে জিএস-এজিএসসহ ২৩টি পদে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ। তবে ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদকের পদে জিতে চমক দেখান সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের দুই নেতা নুরুল হক নূর ও আক্তার হোসেন।
কয়েক মাস পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে চাঁদা দাবির খবর চাউর হলে পদ হারান ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। কিন্তু রাব্বানী উপাচার্যের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে যান।
এরপর উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এক মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহা হয়নি।
এ বছর উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও। সাধারণ শিক্ষার্থীদের টানা ১২ দিনের বিক্ষোভের মুখে ৩০ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিন।
শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেওয়ার পর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এসএম ইমামুল হকের অপসরাণ দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় মার্চের শেষে। ওই অবস্থায় ১১ এপ্রিল উপাচার্যকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। ছুটিতে থাকাকালেই তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
রেজিস্ট্রার চাকরিচ্যুত হওয়ায় এবং কোষাধ্যক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে শীর্ষ তিন পদ শূন্য হয়ে গেলে নতুন সংকটে পড়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ছয় মাস খালি থাকার পর গত নভেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছাদেকুল আরেফিনকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অক্টোবরের শেষভাগে পদত্যাগ করেন বেসরকারি আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক কাজী শরিফুল আলম।
উপাচার্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদত্যাগের নভেম্বরের শুরুতে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (পাবিপ্রবি) আন্দোলন হয়। বিভিন্ন দাবিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন করে।
আর আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দুই মাস বন্ধ থাকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।
গুজব
‘পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে’- এমন এক গুজব ছড়ানো হয় বছরের মাঝামাঝি সময়ে। সেই মাথার জন্য শিশুদের চুরি করে নেওয়া হচ্ছে – এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে জনমনে তৈরি হয় আতঙ্ক। জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার খবর আসতে থাকে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ওই গুজবে বিভ্রান্ত না হতে প্রসনোট দিতে হয় সরকারকে। পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় কয়েক ডজন মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। জুলাইয়ের শেষ দিনে পালন করা হয় ‘গুজবের বিরুদ্ধে সচেতনতা সপ্তাহ’।
এরই মধ্যে ২০ জুলাই উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটকে ৪২ বছর বয়সী তাসলিমা বেগম রেনুকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মানুষের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার প্রমাণ হয়ে সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
চার বছর বয়সী মেয়েকে ভর্তির বিষয়ে খবর নিতে সেদিন ওই স্কুলে গিয়েছিলেন রেনু। কিন্তু স্কুলের মাঠে নিছক সন্দেহ থেকে তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন অভিভাবকরা। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রধান শিক্ষকের অফিসে। পরে সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে স্কুলের গেইটের সামনে ফেলে রড দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়। সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয় বহু মানুষ।
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ভোলার বোরহানউদ্দিনে এক হিন্দু তরুণের ফেইসবুক আইডি ‘হ্যাক করে অবমাননাকর’ বক্তব্য ছড়ানো হয়। সেই বক্তব্য দেখিয়ে উসকে দেওয়া হয় মানুষকে। সেই তরুণের শাস্তি দাবিতে ২০ অক্টোবর ‘মুসলিম তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে ডাকা হয় সমাবেশ। সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যে গুলিতে নিহত হন চারজন।
পেঁয়াজের দাম নিয়ে বাজার যখন অস্থির, ঠিক সেই সময় আরও একবার গুজবের কবলে পড়ে দেশ। ১৯ অক্টোবর হঠাৎ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে- লবণের দাম বেড়ে গেছে। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হলেও লবণ ছাড়া সম্ভব না, ফলে বিশ্বাস নড়ে যাওয়া মানুষ হামলে পড়ে মুদি দোকনে।
সুযোগ বুঝে অনেক দোকানি দাম বাড়িয়ে দেন, ৩৫ টাকার লবণ বিক্রি করেন ১০০ টাকায়। কেউ কেউ শুরু করেন মজুদ। প্রয়োজন না থাকার পরও কেউ কেউ কেজি কেজি লবণ কিনে বাড়ি ফেরেন।
এই পরিস্থিতিতে দেশে লবণের মজুদের তথ্য তুলে ধরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সঙ্কটের কোনো কারণই নেই। কোনোভাবে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা হলে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
লবণ নিয়ে কারসাজি ঠেকাতে মাঠে নামে পুলিশ, র্যাব, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ। তড়িৎ পদক্ষেপে এ যাত্রা দুই দিনেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অপেক্ষা
নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া এখনও অনিশ্চিত। ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের কথায় আস্থা রাখতে না পারায় এ বছর প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
গত দুই বছরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণ।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই শরণার্থীদের সাদরে গ্রহণ করে, খাবার আর আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল কক্সবাজারের মানুষ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ আর রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব বাড়ছে।
বাংলাদেশ সরকার সরাসরিই বলেছে, প্রস্তুতি নেওয়ার পরও মিয়ানমার সরকার একের পর এক অজুহাত তোলায় প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে। অন্যদিকে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারার জন্য বাংলাদেশকে দুষছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলে আসছে তারা। একে ‘মিথ্যাচার’ আখ্যায়িত করে গত মাসে দুই দফা কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
২০১৭ সালের অগাস্টের পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে হত্যা-ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও চালানো হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করার অভিযোগ এনে এ বছর জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া।
গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর দ্য হেগের পিস প্যাসেলে দুই পক্ষের শুনানি শেষে বিষয়টি আদেশের জন্য অপেক্ষমান রেখেছে আইসিজের বিচারক প্যানেল।
এ শুনানিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি। গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, রাখাইনে সামরিক বাহিনীর অভিযানে কোনো অন্যায় হয়ে থাকলে সামরিক আদালতে তার বিচার হবে। তবে ওই প্রতিশ্রুতি ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’ মন্তব্য করে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে আইসিজের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাময়িক পদক্ষেপ চাওয়া হয়।
হলি আর্টিজান মামলার রায়
তিন বছর আগে ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার ঘটনার দায়ের করা মামলার রায় হয়েছে এ বছর।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গত ২৭ নভেম্বর আলোচিত ওই মামলার রায় দেয়। হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা চালিয়ে ২২ জনকে হত্যার দায়ে নব্য জেএমবির সাত সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ওই রায়ে। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার আরেক আসামিকে খালাস দেন বিচারক।
রায়ে তিনি বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা ‘জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সাত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয় রায়ে।
বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল তরুণের ওই আত্মঘাতী হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি। জানা যায়, কেবল মাদ্রাসাপড়ুয়া গরিব ঘরের ছেলেরা নয়, নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানরাও বাড়ি পালিয়ে নিরুদ্দেশ হচ্ছে; জড়াচ্ছে জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর পথে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, বাংলাদেশ তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস এর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
রায়ের পর আদালত কক্ষেই এক আসামির মাথায় আইএস এর চিহ্ন সম্বলিত একটি কালো টুপি দেখা যায়। এমন টুপি কোত্থেকে, কীভাবে এলো- এ নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। সাত জঙ্গির ফাঁসির রায় অনুমোদনের জন্য মামলার নথি (ডেথ রেফারেন্স) ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়েছে।