ঢাকার কেরাণীগঞ্জের যে কারখানায় আগুনে পুড়ে এরইমধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেই কারখানাটি অনুমোদন ছাড়াই চালানো হচ্ছিল বলে জানিয়েছে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর।
Published : 14 Dec 2019, 12:29 AM
এভাবে পাঁচ বছর ধরে চলা এই কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১৯ জন, তাদের কেউ এখনও শঙ্কা মুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বুধবার বিকালে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কারখানাটিতে আগুন লাগার পর ঘটনাস্থল থেকে একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
দগ্ধ ৩৩ জনকে ঢাকা মডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়, তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয় মধ্যরাত থেকে পরদিন দুপুরের মধ্যে।
এই রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞায় এমন ভয়াবহ বার্ন দেখিনি।”
সামন্ত লাল সেন বলেন, এদের মধ্যে দশজন লাইফ সার্পোটে এবং আটজনকে এইচডিইউতে (হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট) রাখা হয়েছে।
“তাদের কাউকে নিরাপদ বলা যাবে না।”
এই ১৮ জনের বাইরে দুর্জয় দাস নামে এক শ্রমিককে তার স্বজনরা কেরানীগঞ্জের বাসায় নিয়ে গেছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
ওই কারখানার বিষয়ে জানতে চাইলে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ঢাকা) আহমেদ বেলাল বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারখানাটি ছিল অবৈধ, ফায়ারের অনুমতি নিয়েছিল একটি শর্তে যে নব্বই দিনের মধ্যে কারখানার প্রবেশপথের সংখ্যা বাড়াবে। কিন্তু মালিকপক্ষ তা করেনি। ওই কারখানায় ঢোকা ও বের হওয়ার একটিমাত্র পথ।”
এ বছর কারখানাটি পরিদর্শনের পর গত ৫ নভেম্বর মালিকের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করে মামলা করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
জানে আলম নামে চুনকুটিয়ার এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই বছর দুই বার, ২০১৮ সালে একবার এবং ২০১৭ সালে একবার আগুন লেগেছিল কারখানাটিতে।
তিনি বলেন, ওই কারখানার পাশে একটি তিনতলা ভবন রয়েছে। কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম পুরো ভবনটি ভাড়া নিয়ে অফিস করেছেন।
পাঁচ বছর এই কারখানা কীভাবে চলছে-প্রশ্ন করা হলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য আহমেদ বেলাল বলেন, “সেটা আমি বলতে পারব না। আমি এখানে নতুন এসেছি। এসেই পরিদর্শন করে নোটিশ করেছি এবং মামলা করেছি।”
কেরানীগঞ্জে এমন কতগুলো অননুমোদিত কারখানা রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই অঞ্চলের প্রায় বেশিরভাগ কারখানাই অবৈধ।”
নিজেদের জনবল ঘটতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “৩৫টি কারখানার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কিন্তু কারখানার সংখ্যা তো আরও অনেক।”
মালিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা
ওই কারখানার মালিক হাজী মো. নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ও নিহত আলমের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় এই মামলা করেন।
ওই থানার ওসি মো. শাহ জামান বলেন, মামলায় কারখানা মালিক নজরুল ইসলামসহ ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
“মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আসামি নজরুল পলাতক থাকায় তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি, খুব দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।”
ওই এলাকার কয়েকজন জানান, নজরুলের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় হলেও পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় বসবাস করেন তিনি।
১২ জনের মরদেহ হস্তান্তর
নিহত ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তারা হলেন- কেরানীগঞ্জের আলম (৩৫), পিরোজপুরের জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৫), নরসিংদীর বাবলু (২৬), নড়াইলের রায়হান বিশ্বাস (১৬), পটুয়াখালীর ইমরান হাওলাদার (১৮), বরিশালের বাকেরগঞ্জের আব্দুল খালেক (৩৫), মাগুরার জিনারুল মোল্লা (৩২), জয়পুরহাটের সুজন দেওয়ান (১৯), মুন্সীগঞ্জের ফয়সাল দেওয়ান (২৪), টাঙ্গাইলের সালাউদ্দিন (২৬), জয়পুরহাটের ওমর ফারুক (৩২) ও মেহেদী হাসান।
আরও একজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রয়েছে, যার হাতের আংটি দেখে মাহবুব হোসেন বলে শনাক্ত করেছে একটি পরিবার। তবে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে।
আহতদের মধ্যে এখন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন জামালপুরের সোহাগের (১৯) শরীরের ৫০ শতাংশ দগ্ধ; বরিশালের সুমনের (২২) ৫০ শতাংশ, রাজশাহীর মোস্তাকিনের (২২) ২০ শতাংশ, কেরাণীগঞ্জের সিরাজুল ইসলামের (১৯) দেহের ৭০ শতাংশ, মফিজের (৪৫) শরীরের ৪০ শতাংশ, রাজ্জাকের (৪৫) দেহের ৯৫ শতাংশ, সোহাগের (২৫) শরীরের ৫০ শতাংশ, ফিরোজের (৩৯) শরীরের ৫০ শতাংশ, আসাদের (১৪) দেহের ৫০ শতাংশ এবং বিক্রমপুরের আবু সাইদের (২৯) দেহের ৮০ শতাংশ দগ্ধ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে ভর্তি আছেন বশির (১৮), জিশান (৪২), লালমিয়া (৪২), সৈকত (২৬), জাকির (২৪), সাজিদ (২৯), আসলাম (১৯) ও সিরাজ (৫০)।