শান্তি চুক্তির ২২ বছরেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্যাঞ্চলে, বরং সম্প্রতি নানা দলে-উপদলে হানাহানি বেড়েছে। চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণই এসব সংঘাতের মূল কারণ বলে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন।
Published : 02 Dec 2019, 12:20 AM
পার্বত্যাঞ্চলে বাসিন্দা পাহাড়ি ও বাঙালি দুই পক্ষই বলছে, বাগান করতে, গাড়ি চালাতে, পণ্য বিক্রি করতে, সব কিছুতেই চাঁদা দিতে হয়। এমনকি শান্তি চুক্তির বর্ষপূর্তি উদযাপনের অনুষ্ঠানের জন্যও চাঁদা চাওয়া হয়। এই চাঁদাবাজিতে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বাঙালিরাও জড়িত।
রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে যত খুন সবই চাঁদাবাজির জন্য।”
পার্বত্যাঞ্চলে ৩০ বছর কর্মজীবন পার করে গত বছর অবসর নিয়ে বান্দরবানে স্থায়ী হওয়া আব্দুল হাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চাঁদার জন্য আধিপত্য, আর এই আধিপত্য বজায় রাখার জন্য যত হত্যাকাণ্ড ও অশান্তি।”
চাকরি জীবনে চাঁদা দিয়েছেন কি না- জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, দীঘিনালা, তবলছড়ি, তাইডং, গুইমারা, মারিশ্যা, পানছড়ি এসব এলাকায় চাকরিজীবীদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দিতে হয়।
শান্তিচুক্তির আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে বললে তিনি বলেন, “তখন সন্ধ্যার পর চলাচল করা যেত না, এখন রাতে চলাচল করা যায়। তবে এখন চাঁদাবাজি বেড়েছে। আঞ্চলিক দলগুলো বিভক্ত হয়ে খুন বেশি হচ্ছে।”
অবসর জীবনে কলা ও কাঁঠাল বাগান করছেন আব্দুল হাই। তার কাছেও ফোনে চাঁদা চাওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পার্বত্য তিন জেলার ‘একমাত্র সমস্যা’ চাঁদাবাজি।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রসারে চাঁদা আদায় এখন সহজ হয়েছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
কী পরিমাণ অর্থ চাঁদা আদায় হয়- জানতে চাইলে রনবী নামে এক ব্যক্তি বলেন, “এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখান থেকে চাঁদা আদায় হয় না।”
গত রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বসবাসকারীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির এসব অভিযোগ পাওয়া যায়।
এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাহাড়ে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করতে এবং ভূমি দখলসহ পার্বত্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের রাখতে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার ও মজুদ করছে পার্বত্য অঞ্চলের চারটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন।”
পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর ২২ বছর পার হলেও পুরোপুরি শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য জনসংহতি সমিতি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়। এর মধ্যে দিয়ে ওই অঞ্চলে প্রায় দুই যুগের সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) পক্ষ থেকে সেই চুক্তিতে সই করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। চুক্তির বলে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানও তিনি।
কিন্তু সন্তু লারমার সেই দল কয়ে দফায় ভেঙে এখন পাহাড়িদের চারটি দল সক্রিয় রয়েছে। সেগুলো হল- জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (সংস্কারপন্থি)। এসব দলে কোন্দলে পাহাড়ে রক্ত ঝরছে প্রায়ই, রোববারও একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে রাঙামাটিতে।
রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, “এটাও (এই হত্যাকাণ্ড) চাঁদার জন্য আর আধিপত্যের জন্য হয়েছে।”
চাঁদাবাজি চললেও ভয়ে অনেকে পুলিশ জানায় না বলে জানান তিনি।
পুলিশ সুপার বলেন, “কেউ থানায় এসে অভিযোগ করে না যে আমার কাছে চাঁদা চেয়েছে। কিন্তু কোনো ঘটনা ঘটে গেলে পরে তদন্তে আসে যে চাঁদা না দেওয়ায় বা চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে এই ঘটনা।”
বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জাকির হোসেন মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইদানীং পাহাড়ি আঞ্চলিক কিছু সংগঠন বান্দরবানকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনোখুনি হচ্ছে।”
তবে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলেন, অন্য পার্বত্য জেলার তুলনায় বান্দরবানে সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে ১১টি জাতি গোষ্ঠী বসবাস করছে।
তার ভাষ্যে, এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা অবৈধ অস্ত্র এবং ভূমি জটিলতা। এই অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছে কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন।
ক্য শৈ হ্লা বলেন, “পার্বত্য অঞ্চলের এসব অবৈধ অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অভিযান পরিচালনা করা উচিৎ। কেননা এখানে অস্ত্রের রাজনীতি বা চাঁদাবাজি করলে শান্তিচুক্তি শতভাগ কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হবে না।”