তদন্তে দোষ পেয়ে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসির তদন্ত কমিটি।
Published : 30 Sep 2019, 12:10 AM
তাদের এই প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছেন উপাচার্য নাসির।
রোববার রাত ৯টার কিছুক্ষণ পর কড়া পুলিশ পাহারায় নিজের কোয়ার্টার থেকে গাড়িতে করে তিনি ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। তিনি ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন বলে গোপালগঞ্জ থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন।
ক্ষমতার অপব্যবহারসহ ‘অনিয়মের’ নানা ঘটনায় আলোচিত এই উপাচার্যের ক্যাম্পাস ত্যাগের সময় শিক্ষার্থীরা উল্লাস করেছেন। তবে সংঘর্ষের কোনো ঘটনা ঘটেনি সেখানে। অনেকটা নির্বিঘ্নেই তিনি চলে যান বলে ওসি জানিয়েছেন।
উপাচার্য নাসিরের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈতিকস্খলনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছিল ইউজিসি। গোপালগঞ্জে গিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন জমা দেন তারা।
তদন্ত কমিটি রোববার সকালে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কাজী শহীদুল্লাহর হাতে প্রতিবেদন দেওয়ার পর এদিনই তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়ে দেন তিনি।
ওই প্রতিবেদনে উপাচার্যকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়েছে বলে ইউজিসির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান অবস্থা, সেখানে উপাচার্যের কী ভূমিকা, দায় কার- তা রয়েছে প্রতিবেদনে। বিভিন্ন অনিয়ম-অভিযোগসহ সার্বিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বর্তমান ভিসির পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আর সম্ভব হবে না বলে মনে করে কমিটি।”
একটি ফেইসবুক পোস্টের জন্য গত ১১ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ও আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে সময়িক বহিষ্কার করার পর উপাচার্য নাসিরের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ওই শিক্ষার্থী ও উপাচার্যের কথোপকথনের একটি অডিও ভাইরাল হয়, যেখানে ওই ছাত্রীকে বকাঝকা ও হুমকি-ধমকি দিতে শোনা যায় উপাচার্যকে। মেয়েটির বাবাকে নিয়েও তীর্যক মন্তব্য করেন তিনি।
এই অডিও ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে উপাচার্যের সমালোচনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হয়। বিক্ষোভের মুখে ১৮ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ১৪টি বিষয়ে আশ্বাস দেওয়া হয়, যার মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাক্স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ছাড়া বহিষ্কার না করা, অভিভাবকদের ডেকে এনে অপমান না করা এবং ফেইসবুক পোস্ট ও কমেন্টকে কেন্দ্র করে কোনো শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
তবে এতে সন্তুষ্ট না হয়ে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনশনসহ আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এ আন্দোলন ঠেকাতে ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন উপাচার্য। শিক্ষার্থীরা তার প্রতিবাদ করলে একদল বহিরাগত হামলা চালিয়ে অন্তত ২০ জনকে আহত করে।
ওই হামলার জন্য উপাচার্যকে দায়ী করে পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন সহকারী প্রক্টর। এদিকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও চলছিল।
এই পরিস্থিতিতে ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কমিটি করে ইউজিসি। তাদের সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও তার আগেই কাজ শেষ হয়।
ইউজিসির সদস্য মো. আলমগীর নেতৃত্বাধীন এই কমিটিতে কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন ও দিল আফরোজ বেগম, ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক কামাল হোসেন এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপ-পরিচালক মৌলি আজাদ ছিলেন।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছি পরদিনই তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দিই। আমরা যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করাতে পেরেছি। আমরা আমাদের পজিশন সরকারকে জানিয়ে দিয়েছি। এখন বাকি কাজ উনারা করবে। পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়।
“অ্যাকশনে যাবে কি যাবে না, তা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। আমাদের রিকমেন্ড করলেই যে মন্ত্রণালয়ের মানতে হবে, করতে হবে তা তো না। আমি তদন্ত করে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
তদন্ত দলের সদস্যরা হামলায় আহত শিক্ষার্থী, সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং লিখিত বক্তব্য নেন। উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের সঙ্গেও কথা বলেন তারা।
বৃহস্পতিবার তদন্ত শেষে দলের প্রধান মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমরা আশা করি, এমন একটি সিদ্ধান্ত হবে, যাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র. শিক্ষক, কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি সুন্দর অবস্থা বিরাজ করবে। এ বিশ্বদ্যিালয়টি আবার অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার দারে ফিরে আসতে পরে।”
অধ্যাপক নাসিরের ক্যাম্পাসত্যাগে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও যত দ্রুত সম্ভব তাকে উপাচার্যের পদ থেকে অপসারণের দাবি করছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
তাদের একজন লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রিয়তা দে রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভিসির পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব। ভিসির পতনের পর আনন্দ মিছিল করে ঘরে ফিরব।”
উপাচার্য নাসির উদ্দিনের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার সাতাশিয়া গ্রামে।
ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সেখানেই বায়ো টেকনোলজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।
নাসির উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় ছাত্রদল করতেন এবং পরে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের প্যানেল সোনালী দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।