মেরুল বাড্ডা থেকে শাহজাদপুর পর্যন্ত এলাকায় অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আর এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বাসা থেকে চলাচলের জন্য রিকশাই ব্যবহার করেন।
Published : 04 Jul 2019, 09:25 PM
কিন্তু আগামী রোববার থেকে প্রগতি সরণিতে (বিশ্ব রোড) রিকশা আর চলবে না; তাহলে কীভাবে যাতায়াত করবেন, তাই নিয়ে ভাবনায় আছেন বাড্ডা এলাকার অনেকে।
মেরুল বাড্ডার বাসিন্দা হাবিবা আক্তার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো বিকল্প না রেখে রিকশা বন্ধ করে দিয়েছে। এ ধরনের কাজ জনগণের সঙ্গে সব সময়ই করা হয়। এবারও তাই করেছে। এত এত মানুষ কীভাবে যাতায়াত করবে, সেই চিন্তা করেনি।”
আগামী ৭ জুলাই থেকে কুড়িল থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রগতি সরণি ছাড়াও সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে এবং গাবতলী থেকে আজিমপুর পর্যন্ত সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ); ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন সিদ্ধান্তটি জানান।
বিকল্প ব্যবস্থা না করে এই সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তে নাখোশ ওই সব এলাকার মানুষ। আয় কমে কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় আছেন রিকশাচালকরাও।
গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা বন্ধের ক্ষেত্রে যানজটের কথা বলা হলেও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রিকশা তুলে দেওয়াই যানজট নিয়ন্ত্রণের একমাত্র সমাধান নয়।
এই সিদ্ধান্তে নগরবাসীর ভোগান্তি এবং খরচ বাড়াবে বলে মত রাজনীতিক ও অধিকারকর্মীদের।
সায়েদাবাদের জনপথ মোড় থেকে খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা হয়ে কুড়িল পর্যন্ত সড়কটি রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণে সংযোগকারী দুটি সড়কের একটি।
এ সড়কে রাইদা, জাবালে নূর, গ্রিন ঢাকা, ভিক্টর, তুরাগ, অনাবিল, আকাশ, ছালছাবিল, প্রচেষ্টা, অছিম ও বিআরটিসির দোতলা বাসও চলাচল করে।
ফলে রিকশার বিকল্প হিসেবে বাসের কথা বলতে পারেন সিদ্ধান্তগ্রহণকারীরা। কিন্তু ওই এলাকার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা, বিআরটিসি ও তুরাগ ছাড়া বাকি বাসগুলো স্বল্প দূরত্বের যাত্রী নেয় না।
বাড্ডা লিঙ্ক রোডের বাসিন্দা আশরাফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এই রাস্তা দিয়ে কাছাকাছি ক্লিনিকে যাই। যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরায় প্রায়ই যেতে হয় বিভিন্ন কাজে।
“এই সড়কে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাস কাছাকাছি দূরত্বের যাত্রী নেয় না, দরজা বন্ধ করে রাখে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসে ওঠাও মুশকিল “
ফলে রিকশা না থাকলে চলাফেরা ‘কঠিন’ হয়ে পড়বে আশরাফুলের মতো অনেকের।
গাবতলী থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত অনেক আগের; এখন নীলক্ষেত থেকে আজিমপুর পর্যন্ত সড়কটিও তার সঙ্গে যুক্ত হল।
২০০২ সালে গাবতলী থেকে রাসেল স্কয়ার , ২০০৪ সালে রাসেল স্কয়ার থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়। তবে ওই সড়কের কিছু অংশে এখনও রিকশা চলাচল করে।
আজিমপুর পর্যন্ত রিকশা চলাচল বন্ধ করলে রোজগার কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন রিকশাচালক।
সোহেল রানা নামে এক রিকশাচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইদিকে রিকশায় খ্যাপ বেশি পাওয়া যায়। এই রাস্তায় রিকশা বন্ধ করে দিলে আমাদের ইনকাম কমে যাবে।”
নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করতে ওই এলাকার যারা রিকশায় যান, তাদেরও পড়তে হবে সমস্যায়।
লালবাগের বাসিন্দা সম্রাট ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেনাকাটা বা কোনো দরকারে সাধারণত রিকশা করেই আসা হয়, কিন্তু যদি এই রুটে রিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে বিকল্প হিসেবে ভারী যানবাহন ব্যবহার করতে হবে।”
“কিন্তু সেটাও তো তেমন নেই,” বলেন তিনি।
পুরোপুরি বন্ধ না করে রিকশার জন্য আলাদা লেইন তৈরি করে দেওয়ার পরামর্শ দেন ওই এলাকার ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জাকিয়া চৌধুরী।
নিজের এবং তার মতো আরও শিক্ষার্থীর সমস্যাটি তুলে ধরে তিনি বলেন, “টিউশনি বা অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজে আশেপাশে যাওয়ার জন্য রিকশাটাই ব্যবহার করি। তাই রিকশা বন্ধ করলে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে।”
বাসে চড়তে নারীদের বিড়ম্বনায় পড়ার দিকটি দেখিয়ে জাকিয়া বলেন, “রিকশা চালু রেখে আলাদা লেইন করে দিলে ভালো হয়।”
রিকশা তুলে দেওয়া ‘সমাধান নয়’
রাজধানীতে চলাচলকারী রিকশার প্রকৃত তথ্য নেই কারও কাছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে নিবন্ধিত রিকশা ৫৮ হাজার ৭১৪টি, তবে এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৬০টি ভ্যানও রয়েছে। অন্যদিকে, ঢাকা উত্তর সিটিতে নিবন্ধিত রিকশা আছে ৩০ হাজার।
তবে কমপক্ষে ৫ লাখ রিকশা রাজধানীতে চলছে এবং ১০ লাখের বেশি চালক এসব রিকশা চালান বলে তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মহানগর রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস।
বিআরটিএর হিসাবে বর্তমানে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি আছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৭টি।
এই ব্যক্তিগত যানবাহনকে যানজটের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মারুফ হাসান। একটি গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় প্রতিদিন সাড়ে তিন কোটি ট্রিপ হয়। এর ৪০ শতাংশ হয় রিকশার মাধ্যমে।
মারুফ বলেন, রিকশা বন্ধ করলে সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ বেড়ে যাবে। গাড়ি রেখে সড়কে চলাচলের পথও হবে সঙ্কুচিত।
“একটা প্রাইভেটকার রিকশার চেয়ে আড়াইগুণ বেশি জায়গা নেয়। একটি বড় বাসের জায়গা নেয় এক দশমিক ৮টি প্রাইভেটকার। এসব প্রাইভেটকার পার্কিংয়ে রাস্তার অনেকটা জায়গা দখল করে ফেলা হচ্ছে। অন্যদিকে, রিকশা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সবসময় চলার উপরে থাকে।”
তিনি বলেন, “সারা বিশ্বে পরিবেশবান্ধব অযান্ত্রিক যানবাহন উৎসাহিত করা হয়। আমাদের এখানে হচ্ছে উল্টোটা। রিকশার চেয়ে বেশি যানজট তৈরি করে প্রাইভেটকার। তো কিছু সড়কে প্রাইভেটকারও বন্ধ করে দেখাক।”
বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ বছরে ঢাকায় যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। আর যানজট প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট করছে।
পরের বছর ২০১৮ সালের ১৯ মে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে বছর ৩৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারেরও কম বলে জানিয়েছিল এআরআই।
এ বছর গাড়ির গতি আরও কমেছে বলে জানিয়েছেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, মেট্রোরেলসহ কয়েকটি উন্নয়নকাজের কারণে সড়কে যানজট বেড়েছে।
যানজট নিয়ন্ত্রণে রিকশার পাশাপাশি ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করাও ‘জরুরি’ বলে মনে করেন বুয়েটের এই অধ্যাপক।
তিনি বলেন, “রিকশা তুলে দেওয়াই সমাধান না। আমরা বিভিন্ন সময় প্যাকেজ পরিকল্পনার কথা বলে এসেছি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা যখন যেটা ভালো লাগে, সেটা নিয়ে হয়ত কাজ করবে বা করতে চায়। পুরো কাজটা করতে চায় না”
যানজটের জন্য রিকশাকে দায়ী করার পাল্টায় ঢাকা মহানগর রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল কুদ্দুস বলেন, “তাহলে যেসব সড়কে রিকশা চলে না, সেখানে জ্যাম লাগে কেন?”
রিকশা বন্ধ করে বিশেষ সমাধান হবে না বলে মনে করেন ঢাকার একটি আসনের সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা লোক দেখানো কাজ, কোনো সুফল দেবে না। গণমানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলা হবে। লাখ লাখ মানুষকে সিএনজি অটো রিকশাসহ ব্যয়বহুল যানবাহনে চলতে বাধ্য করা হবে।”
প্রধান তিনটি সড়কে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত শ্রমজীবী মানুষের উপর এটি আরেকটি আঘাত বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
নাগরিকদের অসুবিধার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এসব সড়কে যদি পর্যাপ্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়ত বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেত।”
শহরকে যানজট মুক্ত করার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা দরকার বলে মনে করেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুও।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রিকশার শহর ঢাকা থেকে রিকশা অপসারণ করার আগে পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।”
তবে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মন্তব্য করেছেন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকবান্ধব সরকার। শেখ হাসিনার সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা সবার ভালোর জন্যই নিয়েছেন। রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের নেতিবাচক কোনো মন্তব্য নেই।”