যানবাহনের যে গতিসীমা সরকার ঠিক করে দিয়েছে, বিশেষজ্ঞ ও পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেটি বিজ্ঞানসম্মত তো হয়ইনি, বাস্তবায়নযোগ্যও নয়।
Published : 15 May 2024, 01:53 AM
দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমানোর চেষ্টায় যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হলেও এটি বাস্তবায়নে নানা জটিলতা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
সবচেয়ে বেশি আপত্তি আসছে মহানগরী আর সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতির বিষয়টি নিয়ে। অন্যান্য গাড়ির বেঁধে দেওয়া গতিসীমা কতটুকু মেনে চলা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
যানবাহনের যে গতিসীমা সরকার ঠিক করে দিয়েছে, বিশেষজ্ঞ ও পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেটি বিজ্ঞানসম্মত তো হয়ইনি, বাস্তবায়নযোগ্যও নয়।
৩০ কিলোমিটার গতি নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত ৬০ লাখ ৫৮ হাজার ৯৯৯টি যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেল ৪৪ লাখ ৮ হাজার ৯২৬টি।
দেশে নিবন্ধিত মোট যানবাহনের মধ্যে ঢাকায় ২১ লাখ ২২ হাজার ৫০১টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮৪টি।
গত ৭ মে গতিসীমা নির্ধারণের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এর বিরোধিতা করছেন মোটরসাইকেলের চালকরা। সোমবার বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন বাইকাররা।
তারা বলছেন, ঢাকায় ৩০ কিলোমিটার গতিতে মোটরসাইকেল চালানো সম্ভব নয়।
আর প্রকৌশলীরা বলছেন, নিয়মিত কম গতিতে চালালে মোটরসাইকেল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেলের খরচও বাড়বে।
ঢাকার পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের আরওয়ানফাইভ মডেলের মোটরসাইকেল চালান। ১৫৫ সিসির এই মোটরসাইকেলে ছয়টি গিয়ার।
হুমায়ুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাইক ২ নম্বর গিয়ারে দিলেই স্পিড ৩০ কিলোমিটারের ওপরে উঠে যায়। বাকি তিনটা গিয়ার কি আমি বাড়িতে রেখে আসব? পাঁচটির মধ্যে দুই নম্বর গিয়ারে দিয়ে বাইক চালানো যাবে না। আবার ৬ নম্বর গিয়ারে রাখলে স্পিড এমনিতেই ৫০-৬০ কিলোমিটার উঠে যায়। এগুলো যারা করছে তারা বাস্তবতা বোঝে না।”
বিষয়টি অবাস্তব ঠেকছে মটোব্লগার নাভিদ ইশতিয়াক তরুর কাছেও।
তার ভাষ্য, “অন্যান্য দেশে একটি সড়কে সব ধরনের যানবাহনের জন্য একই গতিবেগ থাকে। এতে যানবাহনগুলোর মধ্যে ছন্দের পতন ঘটিয়ে দিচ্ছেন। একটা বাইক ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলছে, পেছনের যানবাহন আরও বেশি গতিতে চলবে। এতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়তে পারে।”
জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অটোমোবাইলের ওপর গ্রাজুয়েশন করা একেএম আবিদুর রহমান বর্তমানে মোটরসাইকেলের হেলমেটের ব্যবসা করেন। এর আগে আট বছর সুজুকি বাংলাদেশে কাজ করেছেন তিনি।
আবিদুর বলেন, একটি গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষমতা অনুযায়ী যে গতিতে চলার কথা দীর্ঘ সময় ধরে তার চেয়ে কম গতিতে চললে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
“একটি ১৫০ সিসির বাইক ৫ নম্বর গিয়ারে ৩০ কিলোমিটার গতিতে দীর্ঘ সময় চালানো যাবে না। এভাবে চালালে ইঞ্জিনের পিস্টন, ক্রাংকশেফট, গিয়ার মেকানিজম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বেশির ভাগ মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন ‘এয়ারকুলড’, বাতাসে ঠান্ডা হয়। দীর্ঘ সময় কম গতিতে বাইক চালালে ইঞ্জিন অস্বাভাবিক গরম হতে থাকবে। ইঞ্জিনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে অতিরিক্ত তাপমাত্রা।
”যেহেতু ইঞ্জিনটা ধাতব তাই তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় প্রসারণও বাড়তে থাকে। প্রতিটি এলাইনমেন্টসহ অন্যান্য বিষয়গুলো খুব দ্রুত ক্ষয় হয়ে যাবে।”
কম গতিতে চালানোর কারণে তেল বেশি খরচও হবে বলে তুলে ধরেন তিনি।
“ধরুন একটি মোটরসাইকেল এক লিটার তেলে ৩৫ কিলোমিটার যায়। এটা পাওয়া যাবে ৪৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি গতিতে চললে। কিন্তু এর চেয়ে কম গতিতে চললে ওই মাইলেজ পাওয়া যাবে না। তখন মাইলেজ নেমে আসবে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারে।”
গতির রকমফের ঝুঁকি বাড়াবে
বিআরটিএ এক্সপ্রেসওয়েতে ৮০, ৫০ ও ৬০ কিলোমিটার; এ তিন ধরনের গতিসীমা ঠিক করেছে।
>> জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি এ) ৮০ ও ৫০ কিলোমিটার
>> জাতীয় মহাসড়ক (ক্যাটাগরি বি) ৮০, ৪৫ ও ৫০ কিলোমিটার
>> জেলা সড়কে ৬০, ৪০, ৫০ ও ৩০ কিলোমিটার
>> সিটি করপোরেশন/পৌরসভা/জেলা সদরের মধ্য দিয়ে যাওয়া জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৪০ ও ৩০ কিলোমিটার
>> উপজেলা মহাসড়কে ৪০ ও ৩০ কিলোমিটার
>> শহর এলাকায় ৪০ ও ৩০ কিলোমিটার
>> গ্রামীণ সড়ক ৩০ কিলোমিটার হবে সর্বোচ্চ গতিসীমা
বাংলাদেশে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে একপাশে চার লেন, যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত সড়কটি একপাশে চার লেনের। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও এক পাশে দুই লেন। অন্য সড়ক ও মহাসড়কগুলো দুইদিকে এক লেন করে।
চালকরা বলছেন, একপাশে চার লেন এমন সড়কে চার ধরনের গতিতে যানবাহন চলাচল করলে সমস্যা না। তবে দুই লেনের সড়কে এ নিয়ম মেনে চলতে সমস্যা হবে। আবার চার লেনের সড়ক হলেও যানবাহনের চালকরা খুব ঘনঘন লেন পরিবর্তন করেন। ফলে একই সড়কে একাধিক গতিসীমায় গাড়ি চললে জট তৈরি হবে।
পেশাদার মোটরবাইক স্ট্যান্ট মুশফিক হোসেন জেনিথ বলেন, “যে গতি নির্ধারণ করা হয়েছে, দুর্ঘটনার হার বেড়ে যাবে। ৩০ কিলোমিটার গতিতে আপনি চালাচ্ছেন কিন্তু পেছন থেকে বেশি গতির যানবাহন এসে চাপ দিবে। মোটরসাইকেল একটি নির্দিষ্ট লেনে চললে সমস্যা নয়, কিন্তু আমাদের দেশে কোনো যানবাহন নির্দিষ্ট লেন মেনে চলে না।”
কেরানীগঞ্জ-আবদুল্লাহপুর রুটের বাসের চালক মিজানুর রহমান বলেন, “সর্বোচ্চ গতি ৪০ কিলোমিটার করেছে, এই গতিতে বাস চালানো সম্ভব না। রাস্তা ফ্রি থাকলে অন্তত ৬০ কিলোমিটার গতিতে চালাইতে হবে। নইলে যাত্রীরা চিল্লাচিল্লি করে। আর ৪০ কিলোমিটারে চালাইয়া গিয়া সামনে জ্যামে পড়ে থাকলাম। কম স্পিডে আসায় এমনিতেই দেরি হবে, আবার জ্যামের কারণে আরও দেরি হবে।”
বিজ্ঞানসম্মত নয়?
বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যানবাহনের জন্য আলাদা লেন ঠিক করে তার গতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
“আমাদের এখানে যেটা করা হয়েছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। আমাদের এখানে লেইনভিত্তিক যানবাহন চলে না। এখানে অনেক জাতীয় মহাসড়ক আছে দুই লেনের। তার মানে এক লেনে চার ধরনের গাড়ি চলে, চার ধরনের গতিসীমা, এটা তো অবাস্তব।”
তিনি বলেন, গতিসীমা নির্ধারিত হয় সড়কের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। সে হিসেবে এক্সপ্রেসওয়ে করা হয় যানবাহন উচ্চ গতিতে চালানোর জন্য। গ্রামীণ সড়কের কাজ গতি দেওয়া নয়, সেটা প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করবে। সব সড়কে একই ধরনের গতিসীমা দিলে সেই নিয়মটা আর মানা হল না।
“এক্সপ্রেসওয়েতে গতি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য এখানে ভারি বিনিয়োগ করা হয়। আমাদের এখানে এক্সপ্রেসওয়েতে ৮০ কিলোমিটার, জাতীয় মহাসড়কের সর্বোচ্চ গতিও ৮০ কিলোমিটার করা হয়েছে। আপনি যখন দুটি সড়কেই সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার করবেন, তখন আসলে দুটি সড়কের মধ্যে কোনো ভিন্নতা থাকে না। দুটির ফাংশান যে আলাদা সেটা আপনি ধরলেনই না। গতিসীমা নির্ধারণ বিজ্ঞানসম্মত না, বাস্তবায়নযোগ্যও না।”
দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক এই পরিচালক বলেন, যানবাহনের গতি বাংলাদেশে দুর্ঘটনার মূল কারণ নয়। দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে গতির মধ্যে পার্থক্য।
কোন বাহনের সর্বোচ্চ গতি কত হবে, বেঁধে দিল সরকার
“আপনার সড়কে যদি অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত চালক থাকে, আপনার সড়ক, যানবাহন যদি অনিরাপদ হয় তাহলে সেটি উচ্চগতির সড়কের জন্য অনুপযোগী। গতিকে নিয়ন্ত্রণ না করে সড়কে যা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। অনিরাপদ যানবাহন, অপ্রশিক্ষিত চালকদের নিয়ন্ত্রণ করুন, এটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিআরটিএর।”
কর্তৃপক্ষের যুক্তি
গতিসীমা পুনর্বিবেচনা করা হবে কি না এমন প্রশ্নে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরীর ভাষ্য, গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।
“প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনায় কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। গত মাসেও মারা গেছে দুইশ জন। কেন মারা যাচ্ছে, বেশির ভাগই অতিরিক্ত গতির কারণে। আমরা গতিসীমা বাড়িয়ে দেব, তখন আপনারাই আবার বলবেন মৃত্যু বাড়িয়ে দিলেন।”
সড়কে দুর্ঘটনার জন্য অতিরিক্ত গতি না সড়কের অব্যবস্থাপনা দায়ী-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সড়ক ব্যবস্থাপনায় কোথায় ত্রুটি আছে আপনারা বলেন। বিআরটিএ, জেলা পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মামলা হচ্ছে। ব্যবস্থাপনা আর কিভাবে করব?”