নিনাদ খুন: পরিবারের সন্দেহ জমির বিরোধ, ‘ক্লু খুঁজছে’ পুলিশ

জমি নিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে বিরোধের জেরেই ঢাকার খিলগাঁওয়ে শিশু সাফোয়ান আল নিনাদকে হত্যা করা হয়েছে বলে পরিবার সন্দেহ করলেও হত্যাকাণ্ডের চার দিনেও কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2018, 08:09 PM
Updated : 19 June 2018, 08:48 PM

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ ও ‘ক্লু’ পেতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন তারা।

বাসার পাশে খেলতে গিয়ে ঈদের আগের রাতে নিখোঁজ হয় বনশ্রীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র নিনাদ (৮)। ঈদের দিন দুপুরে বাসার পাশের একটি খোলা জায়গায় পণ্য বহনকারী ঢাকনাওয়ালা রিকশাভ্যান থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

নিনাদকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।

সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “পলিথিন দিয়ে ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতের গলার সম্মুখ অংশে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির কালশিটে দাগ রয়েছে। ডান কাঁধের পেছন দিকে হালকা কালো রঙের দাগ।”

এ ঘটনায় নিনাদের বাবা স্বপন বেপারী অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

মামলায় তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনও বেশি দূর এগোতে পারিনি। তবে আমাদের কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছেন। তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। আমরা খুব দ্রুত নতুন তথ্য জানাতে পারব।”

খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া ভুঁইয়াপাড়া এলাকায় নিনাদের মামাবাড়িতে বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে থাকত নিনাদ। তার বাবা স্বপন ব্যাপারী গাজীপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট, মা সোনিয়া আক্তার গৃহিণী। বোনটি ছিল তার ছোট।

নিনাদের মামা সাংবাদিক এস এম মুন্না বলছেন, ওই এলাকায় জমি নিয়ে তার মামাদের সঙ্গে তাদের পরিবারের পুরনো দ্বন্দ্বের কারণে তার ভাগ্নেকে হত্যা করা হয়েছে ধারণা করছেন তারা।

মুন্নারা এখন যে বাড়িতে আছেন সেটি তার মা ছালেহা বেগম ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছেন।

মুন্না বলেন, তার মা পেয়েছিলেন ৫ কাঠা জমি। কিন্তু মামা মো. সালাউদ্দিন ও মো. জহিরুল ইসলাম পুরো জমি না দিয়ে সাড়ে তিন কাঠা জমি তাদের বুঝিয়ে দেন। পরে দেড় কাঠা জমির ভাগ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়।

২০১৪ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে মুন্নার মামারা তাদের বাড়িতে ‘অতর্কিতে হামলা’ চালিয়ে তাকে এবং তার মা-বোন-খালাকে গুরুতর আহত করেন বলে জানান তিনি।

এ ঘটনায় মুন্না একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। ওই মামলায় সালাউদ্দিন ও জহিরুল ছাড়াও মুন্নার মামাত ভাই ফিরোজ মিয়া, আরাফাত ও ফয়সালসহ আরো বেশ কয়েজনকে আসামি করা হয়েছিল। পরে তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন।

পরে মুন্না ওই দেড় কাঠা জমি বুঝে পেয়ে নামজারি করেন। সম্প্রতি সেই জমিতে নিনাদদের পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করছিলেন তিনি।  ঘরের কাজে হাত দেওয়ার পর থেকে আবারও প্রতিপক্ষের হুমকি পেয়েছিলেন বলে জানান মুন্না।

“ধারণা করছি, প্রতিহিংসাবশত তারা আমাদের ভাগ্নেকে খুন করছে,” বলেন তিনি।

তবে মুন্নার এই অভিযোগের বিষয়ে তার মামাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকবার ফোন করলেও কেউ সাড়া দেননি।

হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে মুন্নাদের বাড়ির খুব কাছেই।নিনাদের গায়ে ছিল লাল রঙের হাতাকাটা টি শার্ট, পরনে হাফ প্যান্ট। তদন্তকারী কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে ধারণ করা ছবিতে দেখা যায়, রিকশাভ্যানের ভেতরে পলিথিন দিয়ে তার গলা বেধে রাখা হয়েছিল ভ্যানের রডের সঙ্গে। এক পা ছিল মোড়ানো।

নিনাদের মামা মুন্না জানান, ঈদের দিন দুপুর দেড়টার দিকে তাদের বাসার কাছের রিকশা গ্যারেজের পাশে খালি প্লটে মার্বেল নিয়ে খেলতে খেলতে একটি শিশু রিকশাভ্যানের ভেতরে উঁকি দিয়ে নিনাদের মরদেহ দেখতে পায়।

আগের রাত ১০টার দিকে নিনাদ বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “ঈদের পোশাক আনার জন্য শুক্রবার রাত ৯টার দিকে আমি বাড়ি থেকে বের হই। এর কিছুক্ষণ পর নিনাদ গোসলে ঢোকে। পরে সে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুনসুটি করে।

“তার আম্মাকে কয়েকটা কাগজের টুকরো দেখিয়ে বলে, আম্মা  এই কাগজে তুমি মোবাইল নম্বর লিখে দিবা। তারপর সে বের হয়ে যায়। সে যখন নিখোঁজ হয় তখন ছিল ঝুম বৃষ্টি। বাড়ির সামনে এমনি সময় লোক সমাগম থাকে। বৃষ্টি বলে ওই দিন এত লোক ছিল না।”

মঙ্গলবার নিনাদদের বাসায় দেখা যায় তার মা সোনিয়া আক্তার বাকরুদ্ধ।

বাবা স্বপন ব্যাপারী ছেলের স্কুল ব্যাগ, ড্রয়িং পেন্সিল দেখিয়ে বলেন, “আমার বাপজান আঁকাআঁকি পছন্দ করত। সে ঘরের দেয়ালজুড়ে খালি আঁকত। রাতে সে আমারে জাপটায় ধইরা ঘুমাইত। আমার সঙ্গে স্কুলে যাইত রোজ। ডিম খাইতে খুব পছন্দ করত। আমি রোজ অফিস থেকে আসার সময় তার জন্য ডিম আনতাম।

“কত স্বপ্ন ছিল! স্বপ্ন আর নাই আমার।”

নিনাদের স্কুল ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ শেখ ফরিদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুলের অন্যান্য শিশুদের মতো নিনাদ মোটেও চঞ্চল ছিল না। সে ক্লাসে মনোযোগী ছিল। তার হাতের লেখা ছিল ভীষণ সুন্দর। সে খুব বন্ধুবৎসল ছিল।”

“এমন একটি সুন্দর, সরল শিশুকে কেউ মেরে ফেলতে পারে- এটা কি বিশ্বাস করা যায়? দুনিয়া কি আর দুনিয়া আছে? আমরা কোথায় আছি,” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

পরে তিনি বলেন, ঈদুল ফিতরের ছুটির পর স্কুল খুললে ঘাতকদের বিচার চেয়ে একটি মানববন্ধন করবেন তারা। নিনাদের জন্য বিশেষ দোয়া মাহফিলেরও আয়োজন করা হবে।

নিনাদের স্বজনদের পাশাপাশি এলাকার লোকজনকেও ছুঁয়ে গেছে এই শিশুর মৃত্যু শোক।

নিখোঁজ দিন সকালেও এলাকার চটপটি ও পিঠা বিক্রেতা মো. মানিক রতনের সঙ্গে কথা হয়েছিল নিনাদের।

রতন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামা আমার কাছে চটপটি খাইতে চাইছিল। কইছিল, বড় প্যান্ডেল বানাইতে। আমি বানাইছিলাম। এ ই যে দেখেন, এখনও তেরপাল (ত্রিপল) টানায়া রাখছি।

“সে ছোটবড় সকল বাচ্চাগো লগে মিশত। তার মনটা এত সরল ছিল! সে মুরগি খাইতে ভালোবাসত। তার জন্য আমি মাঝেমধ্যে দেশি মুরগি আইন্যা দিতাম বাড়িতে। কই গেল আমার মামাটা?”

প্রতিবেশী ইসরাফিল আহমেদ নয়ন বলেন, “যখনই ওকে দেখতাম তখনই ওর হাসিমাখা চোখ দুটি দেখতাম। তার মৃত্যুর পর সে চোখ দুটি ভাসছে শুধু।”

বাবা-মামার সঙ্গে বাড়ির কাছের আবু তাহেরের মুদি দোকানে ডিম, দুধ কিনতে আসত নিনাদ।

আবু তাহের বলেন, “সে খুব বায়না করা বাচ্চা ছিল না। তাকে যা দেওয়া হত, সে তাতেই সন্তুষ্ট ছিল।”

পুলিশ এখনও এই হত্যাকাণ্ডের ‘ক্লু’ খুঁজছে জানিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার এসআই নগেন্দ্র কুমার দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনাস্থল পরিদর্শন, এলাকাবাসী ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আমরা আরও অনেক তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। সন্দেহভাজন হিসেবে এখনও কাউকে আমরা আটক করিনি।

“তবে মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে জোর তদন্ত চলছে। আশা করছি, খুব দ্রুত আমরা এই রহস্যের উন্মোচন করব।পারিবারিক বিরোধের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।”

এদিকে র‌্যাবও এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে মাঠে নেমেছে। মঙ্গলবার বিকালে নিনাদের পরিবারের সদস্যদের র‌্যাব-৩ এর কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক ইমরানুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনাটি তদন্তে র‌্যাবের একাধিক দল কাজ করছে। তারা নিহতের পরিবারের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছে। প্রাথমিকভাবে নিহতের বাবা-মা অভিযোগ করছেন জমি জমা সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধের জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

“তাদের এই অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি হত্যায় অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না সেটাও র‌্যাব তদন্ত করে দেখছে। এই নির্মম হত্যায় যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারে র‌্যাব সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।” 

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন গোলাম মুজতবা ধ্রুব]