রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরার ‘অনুকূল পরিবেশ তৈরি’ হলে তাদের প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে।
Published : 13 Apr 2018, 06:15 PM
শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় ইউএনএইচসিআর সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এবং ইউএনএইচসিআরের মহাপরিচালক ফিলিপো গ্র্যান্ডি এই সমঝোতা স্মারকে সই করেন।
ইউএনএইচসিআরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত আট মাস ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা শরণার্থীরা যাতে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারে এবং এই প্রত্যাবাসন যাতে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে হয়, তা নিশ্চিত করতে একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরি করা হয়েছে। তাতে সম্মতি জানিয়েই সই হয়েছে সমঝোতা স্মারক।
সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে আসা চার লাখের মত রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। গতবছর ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে আরও প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা।
জাতিসংঘ ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে আসছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এশিয়ার এ অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সঙ্কটের শুরু থেকেই এই শরণার্থীদের জরুরি সহায়তা ও সুরক্ষা দিয়ে আসায় বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো ত্রিপক্ষীয় চুক্তি না থাকায় জাতিসংঘের এই সংস্থা দুই দেশের সঙ্গেই আলাদাভাবে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছে, যাতে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে যে সম্মতিপত্র সই হয়েছিল, সেখানে দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল দুই দেশ।
ওই সম্মতিপত্রের ভিত্তিতে দুই দেশ গত ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রাথমিক চুক্তিতে জাতিসংঘকে না রাখায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সে সময় সমালোচনা হয়।
জাতিসংঘ মহাসিচব গুতেরেসও সে সময় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয় সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে সঙ্গে রাখা জরুরি ছিল বলে তিনি মনে করেন।
শুক্রবারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউএনএইচসিআর বলেছে, মিয়ানমারে এখনও শরণার্থীদের নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। মিয়ানমার সরকারকে সেই পরিবেশ তৈরির জন্য অবকাঠামোগত প্রস্তুতির বাইরে আরও কাজ করতে হবে।
“বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীরা বলেছে, মিয়ানমারে ফেরার আগে তারা তাদের নাগরিকত্বের অধিকার এবং রাখাইনে নিজেদের ভূমিতে সকল মৌলিক অধিকার নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারার নিশ্চয়তা চায়। “
মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে সম্প্রতি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করে তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিত যে, যত দ্রুত সম্ভব আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব।”
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কি না সে প্রশ্নের জবাবে উইন মিয়াত আয়ে বলেন, মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী যত তাড়াতাড়ি তারা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড নেবে, তত দ্রুত তারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে।
“আইন অনুযায়ী তাদের জাতীয় যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে হবে, যাতে তারপরে তারা নাগরিকত্ব পেতে পারে।”
ইউএনএইচসিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কফি আনান কমিশন রাখাইন সঙ্কটের মূলে যেসব কারণের কথা বলেছে, সেগুলো মেটাতে মিয়ানমার সরকারকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।
“এর প্রথম ধাপে তাদের উচিৎ ইউএনএইচসিআরসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি রাখাইনে নির্বিঘ্নে যাওয়ার এবং কাজ করার সুযোগ দেওয়া, যাতে ইউএনএইচসিআর সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখতে পারে এবং সেই তথ্য বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের জানাতে পারে।”
তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমিতে নতুন করে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করারও সুযোগ তৈরি হবে বলে যুক্তি দিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে যারা এখনও মিয়ানমারের ভেতরে অবস্থান করছে, তাদের নির্বিঘ্নে চলাফেরার সুযোগ নিশ্চিত করা হলে তা বাংলাদেশে অবস্থানরত শরণার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক হবে বলেও ইউএনএইচসিআর মনে করছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইউএনডিপির সঙ্গে মিলে ইউএনএইচসিআর মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই চুক্তির উদ্দেশ্য হল রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফেরার মত অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা এবং রাখাইনের সবার জন্য মানবিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা দেওয়া।