চার বছর ধরে রংপুর মেডিকেলের হিমঘরে থাকা নীলফামারীর হোসনেয়ারা বেগম লাইজুর মৃতদেহ সৎকার নিয়ে জটিলতা কাটল।
Published : 12 Apr 2018, 04:54 PM
লাইজুর মৃতদেহটি তার শ্বশুরের জিম্মায় দিয়ে মুসলিম রীতিতে সৎকার, অর্থাৎ দাফনের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
রায়ের কপি পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্ববধানে আইনশৃংখলা বাহিনীর সহায়তায় মৃতদেহটি দাফন করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, নীলফামারীর ডোমার উপজেলার অক্ষয় কুমার রায় মাস্টারের মেয়ে নিপা রানী একই উপজেলার জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমায়ুন ফরিদ লাজুর সঙ্গে ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর পালিয়ে যান।
এরপর ধর্মান্তরিত হয়ে লাজুকে বিয়ে করেন নিপা। বিয়ের সময় নাম পরিবর্তন করে নিপার নাম রাখা হয় মোছা. হোসনেয়ারা বেগম লাইজু।
এ ঘটনায় নিপার বাবা অক্ষয় কুমার রায় ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর নীলফামারী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে একটি অপহরণ মামলা করেন।
কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ের কাগজপত্র আদালতে দাখিল করে লাইজু ও লাজু জবানবন্দি দিলে আদালত অপহরণ মামলাটি খারিজ করে দেয়। এরপর অক্ষয় কুমার খারিজের বিরুদ্ধে আপিল করে তার মেয়েকে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মস্তিষ্ক বিকৃত বলে দাবি করেন।
পরবর্তিতে আদালত এই আবেদন আমলে নিয়ে মেয়েটিকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য রাজশাহী সেফহোমে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়।
লাইজু সেফহোমে থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি তার স্বামী হুমায়ূন ফরিদ লাজু বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
এরপর লাজুর আত্মহত্যার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করে অক্ষয় কুমার মেয়েকে তার জিম্মায় নিতে আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করে।
আদালতের আদেশ পেয়ে মেয়েকে নিয়ে নিজ বাড়িতে রাখেন অক্ষয় কুমার। কিন্তু ২০১৪ সালের ১০ মার্চ নিজ বাড়িতে কীটনাশকপানে আত্মহত্যা করেন নিপা ওরফে লাইজু।
ওই বছরের ১১ মার্চ নীলফামারী জেলার মর্গে লাশের ময়না তদন্ত হয়। তখন লাজুর বাবা জহুরুল ইসলাম দাবি করেন লাইজু তার পুত্রবধূ। সুতরাং মুসলিম নিয়মে তার সৎকার হতে হবে।
এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জের গড়ায় আদালত পর্যন্ত। পুত্রবধূ দাবি করে শ্বশুর জহুরুল ইসলাম মুসলিম রীতিতে দাফনের জন্য আদালতে আবেদন করেন। অক্ষয় কুমারও মেয়ের মৃতদেহ তার ধর্মমতে সৎকারের জন্য আদালতে আবেদন করেন।
উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে জেলা হাকিম ডোমার থানা পুলিশকে ঘটনাটি প্রতিবেদন আকারে দাখিলের আদেশ দেন। কিন্তু উভয়পক্ষ নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে ডোমার থানা পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করলে আদালত মৃতদেহটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংরক্ষণের আদেশ দেয়। এরপর থেকে নিপা ওরফে লাইজুর মৃতদেহ সেখানেই রয়েছে।
পরে মামলার শুনানি শেষে জেলা হাকিম আদালত শ্বশুরের পক্ষে রায় দেয়। এ রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে অক্ষয় কুমার সাব-জজ আদালতে আপিল করেন। সাব-জজ আদালত তার পক্ষে রায় দেয়।
এ রায়ের বিরুদ্ধে শ্বশুর জহুরুল ইসলাম হাই কোর্টে আপিল করেন। ওই আপিলের শুনানির পর বৃহস্পতিবার এ রায় দিল উচ্চ আদালত।
আদালতে লাইজুর শ্বশুর জহুরুল ইসলামের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী একে এম বদরুদ্দোজা। আর বাবা অক্ষয় কুমারের পক্ষে ছিলেন সমীর মজুমদার।
রায়ের পর আইনজীবী সমীর মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, “চার বছর ধরে মর্গে থাকা নিপা রানী রায় বা ধর্মান্তরের পর হোসেনেয়ারা বেগম লাইজুর লাশ মুসলিম রীতিতে দাফনের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
“আদালত বলেছেন, একটি লাশ দীর্ঘ চার বছর ধরে মর্গে পড়ে আছে। এটা একটি অমানবিক। লাশটির দাফন হওয়া উচিত। তাই একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্ববধানে আইনশৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতায় লাশটি দাফন করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়ছে। একই সঙ্গে নিপার বাবা-মা বা তার আত্মীয়-স্বজনেরা দেখতে চাইলে সেই সুযোগ দিতেও বলা হয়েছে।”
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে আইনজীবী সমীর বলেন, “এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাছাড়া আমরাও চাচ্ছি লাশটি দ্রুত সৎকার করা হোক।”