সাহিত্যের সব শাখার বইগুলো পেতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা মুখিয়ে থাকলেও তাদের সেই চাহিদা পূরণ হয় না, যার জন্য অর্থ সংকটের কথা জানালেন ব্রেইল বই প্রকাশের উদ্যোক্তা।
Published : 16 Feb 2018, 11:42 PM
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সাহিত্যের স্বাদ দিতে ২০০৯ সালে স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু করে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা, দুই বছর বছর তারা স্টল নিয়ে বসে বইমেলায়। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সৈয়দ শামসুল হক ও কবীর চৌধুরীর মতো লেখকদের প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, অনুবাদ, উপন্যাস ব্রেইলে প্রকাশ করেছে তারা।
এবার বইমেলায় আত্মজীবনী, উপন্যাস, অনুবাদ, গল্পগ্রন্থ, স্বাস্থ্য ও রান্না বিষয়ক বই ব্রেইলে প্রকাশ করেছেন বলে জানান স্পর্শ’র প্রধান উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীন।
তিনি শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্রেইল বই পেতে মুখিয়ে থাকেন ব্রেইল পাঠকরা। কিন্তু আমাদের অর্থাভাব রয়েছে, ইচ্ছা থাকলেও আমরা অনেক বই প্রকাশ করতে পারছি না। আমাদের সঙ্গে জাফর ইকবাল, সেলিনা হোসেনের মতো অনেক লেখক এগিয়ে এলেও এই যাত্রায় আরও উদ্যোগ দরকার।”
তিনি বলেন, “সাধারণ যে কোনো বইয়ের চেয়ে ব্রেইল বই ছাপাতে তিন-চারগুন খরচ হয়। ব্রেইল বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠার জন্য ৭ টাকা, স্পাইরাল বাইন্ডিং করতে গেলে ২০ টাকা ও সাইটেশন থাকলে আরও ১০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়।”
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বইয়ের চাহিদা মেটাতে অন্যান্য প্রকাশনীর উদ্যোগ প্রত্যাশা করে নাজিয়া বলেন, “বড় প্রকাশনীগুলো যদি এগিয়ে আসত, তাহলে আরও ভালো হত। যদি বাংলা একাডেমি নিয়ম করত, বড় প্রকাশনীগুলো থেকে একটি করে ব্রেইল বই প্রকাশ করতে হবে, তবে আমরা আরও অনেক বেশি ব্রেইল বই পেতাম।”
নাজিয়া জাবীন বলেন, তাদের এই পথচলা মসৃন ছিল না। বইমেলায় অংশ নিতে এসে প্রথম দিকে অনেকের টিপ্পনী ও বিদ্রূপ শুনতে হয়েছে।
এ সময় স্টলকর্মীর সঙ্গে কথা বলে মা জানান, বইগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য।
সব শুনে মন খারাপ করে শিশুটি।এরপর ওই স্টলে আসা দৃষ্টিহীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার রিমার দিয়ে এগিয়ে যায় সে। ছোট দুটি হাত বাড়িয়ে ধরে তার দুই হাত। খুদে পাঠক রিমাকে বলে, “তোমার কি অনেক বই পড়তে ইচ্ছা করে? তাহলে বই পড়বে। আমিও অনেক বই পড়ি। বই পড়লে কত কিছু জানা যায়!”
নাজিয়া বলেন, “২০১১-১২ সালে মানুষ স্টলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও জানতে চাইত না, এই ব্রেইল বই কী? অথচ আজ দেখুন, কত পাঠক জেনে গেছে, ব্রেইল প্রকাশনা কী। এভাবে সচেতনতা বাড়লে, মানুষের সহমর্মিতা পেলে নিশ্চয় একদিন আমরা সব প্রকাশকরা মেলায় আরও অনেক ব্রেইল বই নিয়ে আসব।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী শারমিন আক্তার রিমা জানান, এ বছর ব্রেইল বই পেতে নিবন্ধন করে তিনি আর চট্টগ্রামে বসে থাকেননি। চলে এসেছেন ঢাকায়, এরপর সোজা বইমেলায়।
“আমি তো অনেক বই পড়তে চাই। কিন্তু সেই বই কোথায়? স্পর্শে এসে আমি বেশ কটি বই পেয়েছি। সবাই যদি বই বের করত আমাদের জন্য, তাহলে ভীষণ ভালো হত!”
রিমা নিজেও কবিতা, গল্প লেখেন। একদিন তার লেখা কবিতা ও গল্পের বই প্রকাশিত হবে বলে প্রত্যাশার কথা জানান তিনি।
পরে নাজিয়া জাবীন জানান, এ বছর স্পর্শ প্রকাশনা থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের গল্পগ্রন্থ ‘আঁখি এবং আমরা কজন’ ও কিশোর উপন্যাস ‘আমি তপু’, মালেকা বেগমের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘সুফিয়া কামাল’, ফেরদৌস খানের অনুবাদ গ্রন্থ ‘আমপারা’, লুৎফুর রহমান রিটনের ‘ঝ্যাং এবং প্যাং’, শাহরিয়ার হোসেনের উপন্যাস ‘কলঙ্কভাগী’, আনিসা হকের শিশুতোষ গ্রন্থ ‘সুন্দরবনে সাদা পাহাড় ও ছোটবেলার কথা’, নাজিয়া জাবীনের ‘হাঁসের পায়ে ঘুড়ি’, সোনিয়া হকের উপন্যাস ‘অনন্তনিদ্রা’, মোহিত কামালের মনোবিজ্ঞান বিষয়ক গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নডানা প্রকাশিত হয়েছে।
এর বাইরে মেয়েদের স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে নারীপক্ষ’র বই ‘মেয়েদের সাদা স্রাব যখন সমস্যা’ এবং রান্না বিষয়ক ‘আল্পনা হাবীবের রান্না’ ও ‘লবী রহমানের রান্না’ প্রকাশ করেছে স্পর্শ।
নাজিয়া জানান, এবার বইমেলায় অর্ধশতাধিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণী তাদের এখানে নিবন্ধন করেছেন। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের হাতে বিনামূল্যে এ বছরের ব্রেইল বইগুলো তুলে দেওয়া হবে।
দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে স্পর্শ ব্রেইলে ফোন করেও ব্রেইল বই পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।