পুলিশকে এড়িয়ে আদালতে আত্মসমর্পণকারী এক ভুয়া চিকিৎসককে থানায় তুলে দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 11 Dec 2017, 07:16 PM
অর্জুন চক্রবর্তী নামে চাঁদপুরের এই ব্যক্তি রাজন দাস নাম ভাঁড়িয়ে ভুয়া সনদ দেখিয়ে পটুয়াখালীর বাউফলে নিরাময় ক্লিনিকে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন।
কয়েক মাস আগে এক নারীর প্রসবের সময় অস্ত্রোপচারের পর পেটে গজ রেখে সেলাই করে দিয়েছিলেন তিনি। ঘটনাটি গণমাধ্যমে দেখার পর গত ২৩ জুলাই স্বতপ্রণোদিত হয়ে হাই কোর্ট রুল দেয়।
পরে পটুয়াখালীর সিভিল সার্জনের কাছে ঘটনার বিষয়ে প্রতিবেদন চায় হাই কোর্ট। সে প্রতিবেদনেই চিকিৎসক রাজন দাসের ভুয়া সনদের বিষয়টি ধরা পড়ে।
এরপর গত ৬ নভেম্বর রাজনকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে হাই কোর্টে হাজির করতে বাউফল থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কিন্তু ওসি আদালতকে তার ব্যর্থতার কথা জানান।
এর মধ্যে সোমবার রাজন নিজেই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। নিরাময় ক্লিনিকের পরিচালক আব্দুর রহমান, রাজনের সহকারী তোফায়েল সিকদার ওরফে মিশুও আদালতে উপস্থিত হন।
বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের বেঞ্চে তারা উপস্থিত হলে শুনানির শুরুতেই আদালত বলে, সেই লোক (রাজন দাস) কোথায়?
তখন তাকে দেখিয়ে তার আইনজীবী গোলাম নবী বলেন, “হি ইজ দ্য পারসন।”
আদালত বলে, তাকে অ্যারেস্ট করে আনতে বলেছি। এএজি (অ্যাসিসট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল) সাহেব কই?
রাজনের আসল অর্জুন চক্রবর্তী এবং বাড়ি চাঁদুপরের মতলবে বলে আদালতকে জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
আদালত তখন রাজনকে কাছে ডেকে তার নাম জিজ্ঞেস করে।
জবাবে রাজন পরিচিয়ে উপস্থিত ব্যক্তিটি বলেন, অর্জুন চক্রবর্তী।
রাজন কে- আদালত প্রশ্ন করলে তিনি নিরুত্তর থাকেন।
বিচারক তখন ভুয়া রাজনকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কি ডাক্তার?”
জবাবে তিনি বলেন, “না। অল্টারনেটিভ মেডিসিন।”
এসময় আইনজীবী নুরুল ইসলাম সুজন ভুয়া চিকিৎসক রাজন দাসের পক্ষে দাঁড়াতে চাইলে বিচারক বলেন, “হি ইজ আ ফেইক ডক্টর। মি. ইসলাম ছবিগুলো দেখেন (ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও অস্ত্রোপচারের বীভৎস ছবি)।”
এরপর বিচারক ভুয়া রাজনকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি ডাক্তার না হয়ে মহিলার পেট কেটেছেন। আমাদের মানুষদের কি কোনো দাম নাই? কসাইরাও তো এরকম করে না। ওদেরও একটি নিয়ম আছে। ভুয়া ডাক্তার আপনি।
“অ্যারেস্ট হিম, এক্ষুনি তাকে অ্যারেস্ট করেন। পুলিশ কই? সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে দিয়ে দেন। শাহবাগ থানায় তুলে দেওয়ার জন্য।”
এ সময় পটুয়াখালীর সিভিল সার্জনের আইনজীবী শামসুদ্দিন বাবুল বলেন, “সে তো রাজন না। রাজনের ছবির জায়গায় ছবি লাগিয়ে রাজন দাস হয়েছে।”
তখন বিচারক নিরাময় ক্লিনিকের মালিক আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনার এটা কি (নিরাময় ক্লিনিক) হাসপাতাল না কসাইখানা?”
ভুয়া রাজনকে দেখিয়ে বলেন, “এর সার্টিফিকেট আছে? ও কি ডাক্তার? অপরেশন কি উনি করেছেন? আপনারা কি জানেন?”
জবাবে ক্লিনিকের মালিক আব্দুর রহমান বলেন, সনদের ফটোকপি নিয়েছিলেন তিনি।
বিচারক বলেন, “শুধু পেট কেটে সেলাই করলে ডাক্তার হয়ে যায়? ওটা কি ক্লিনিক নাকি কসাইখানা? এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। ভিকটিমের কোনো খোঁজ-খবর নিয়েছেন?”
জবাবে আব্দুর রহমান বলেন, “আমরা রোগীর চিকিৎসার জন্য এক লাখ ১৩ হাজার টাকা দিয়েছি।”
বিচারক বলেন, “এতে সব হয়ে গেছে? এক লাখ ১৩ হাজার টাকাই কি যথেষ্ট?”
আব্দুর রহমান বলেন, “না, লাগলো আরও দেব।”
এরপর ভুয়া চিকিৎসক রাজন দাসের সহকারী মিশু সিকদারকে সামনে ডেকে বিচারক বলেন, “তার সঙ্গী ছিলেন আপনি, আপনি জানেন না যে সে ভূয়া ডাক্তার?
মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট মিশু বলেন, “আমাকে যে ডাক্তার দেবে আমি তার সঙ্গেই কাজ করব। আমি কীভাবে বুঝব? এটা তো প্রতিষ্ঠান দেয়।”
এরপর বিচারক ভিকটিমের অস্ত্রোপচারের সময়ের ছবি দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করে বলে, “আমরা কোন যুগে বাস করছি! এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে! আমাদের সময়ে তো এসব শুনিনি। এটা ভয়ানক! মার্ডারের মতো কাজ!”
এ সময় ভুয়া চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারের শিকার মাকসুদা বেগমের আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক বলেন, তার এ ক্ষত অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হবে।
এ পর্যায়ে শামসুদ্দিন বাবুল বলেন, “ও তো (রাজন দাস) মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। রাজন দাসের নামে তার আইনজীবী বিভিন্ন সময় আবেদন করেছিল। এখন এ মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো রুল জারি করা উচিৎ।”
তখন আদালত বলে, আগে পুলিশের কাছে সোপর্দ হোক, তারপরে দেখা যাবে।
আদালতের ডাকে হাই কোর্ট বিভাগের একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রার এলে ভুয়া চিকিৎসক রাজন দাস, ক্লিনিকের মালিক আব্দুর রহমান, চিকিৎসকের সহকারী মিশু ও ওই ক্লিনিকের নার্স জাহেদাকে আসামি করে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেয়। একইসঙ্গে কথিত রাজন দাসকে সে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করার নির্দেশ দেয়।
শামসুদ্দিন বাবু সাংবাদিকদের বলেন, ‘কথিত রাজন দাসের বিরুদ্ধে বাউফল থানায় একটি মামলা আছে। তাকে সে মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে শাহবাগ থানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছে। এছাড়া এ ঘটনার সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বাউফল থানার ওসিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”
ইমরান এ সিদ্দিক বলেন, “ভুয়া চিকিৎসক, ক্লিনিকের মালিক, নার্স ও মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেওয়ার পর আমরা ডেপুটি রেজিস্ট্রারের কক্ষে যাই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজনের বিরুদ্ধে এ ঘটনায় বাউফল থানায় একটি মামলা আছে।
“যেহেতু এক অপরাধে দুই মামলা হয় না, তাই দুপুর ১টার দিকে বিষয়টি কোর্টের নজরে আনি। পরে কোর্ট রাজনকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করতে নির্দেশ দেন। অপর তিনজনের বিষয়ে আদালত কিছু বলেননি। তবে ১৩ ডিসেম্বর এ বিষয়ে আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন।”