পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হচ্ছে না; বিভিন্ন অ্যাপ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগের মতোই পরীক্ষা শুরুর আগেই আসছে প্রশ্নপত্র, যা হুবহু মিলেও যাচ্ছে।
Published : 07 Nov 2017, 07:05 PM
চলমান জেএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নপত্রও ফেইসবুকে পাওয়া গেছে; যার সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের পুরোপুরি মিল পেয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
গত সোমবার (৬ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হয় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। ওই পরীক্ষা শুরুর ৫৫ মিনিট আগে প্রশ্নপত্র পাওয়া যায় একটি ফেইসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে।
অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে তা মিলে যাওয়ার পর সোমবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে তা জানানো হয় ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকারকে।
ফেইসবুক একাউন্টের আইডি লিঙ্কটিসহ প্রশ্নের জন্য অর্থ চেয়ে দেওয়া মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট নম্বর জানিয়ে তাকে ই মেইল করা হয়।
তখন তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, পুলিশের সহায়তা নিয়ে বিষয়টি দেখে অপরাধীকে শনাক্ত করা হবে।
কিন্তু তার মধ্যেই মঙ্গলবার পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে একই মেসেঞ্জার গ্রুপে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার প্রশ্নও চলে আসে, যাও মিলে যায়।
এরপর যোগাযোগ করা হলে তপন কুমার বলেন, “আপনাদের (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম) কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে) জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখছে, (অপরাধীকে) ধরার চেষ্টা করছে।”
তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরও ফেইসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপটি সক্রিয় দেখা যায়। তাতে বুধবার অনুষ্ঠেয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘোষণাও দেওয়া হচ্ছিল।
তবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার বলেন, “আমি এটাকে প্রশ্ন ফাঁস বলতে পারি না, আমাদের কাছে তো এখনও কোনো প্রমাণ নেই। ফাঁসের কোনো নমুনা তো দেখছি না।”
কখন প্রশ্ন হাতে এলে তাকে ফাঁস বলা হবে, আগের রাতে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নির্ধারিত সময়ের আগে প্রশ্ন বেরিয়ে যাওয়া তো উচিৎ না বলে আমি মনে করি। সেটা কীভাবে বের হচ্ছে, কী বিষয়-আশয় তা জেনে তারপর আপনাকে বলতে হবে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না বিষয়টা।”
সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা পরীক্ষা শুরুর ঠিক আগে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করে আসছেন। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন বের করার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্ন বাইরে চলে আসতে পারে বলে তাদের ধারণা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও শিক্ষকদের হুঁশিয়ার করে আসছেন।
এবারের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গত বছর ঢাকা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল হোয়াটস অ্যাপে; তার আগের বছর এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল ফেইসবুকে।
তখন শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন মহল সোচ্চার হলেও প্রশ্ন ফাঁসের কথা স্বীকার করেননি শিক্ষামন্ত্রী; তবে পরীক্ষার সময় মোবাইল ফোন ও ফেইসবুক বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এখন তিনি শিক্ষকদেরই দুষছেন বেশি।
যেভাবে মেলে প্রশ্ন
শিক্ষার্থী সেজে একটি ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে যোগাযোগের মাধ্যমে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত হয়ে প্রশ্ন পান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক। গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া জেএসসি ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের হাতে লেখা উত্তরসহ ইমেজ আকারে বোর্ড প্রশ্ন পরীক্ষার ৫৫ মিনিট আগে দেওয়া হয় ওই গ্রুপে। প্রশ্ন পাওয়ার পর টাকা দিতে একটি রকেট ও একটি বিকাশ নম্বরও দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের বহুনির্বাচনী পরীক্ষার হাতে লেখা উত্তরসহ ইমেজ আকারে বোর্ডের একটি প্রশ্নপত্র গ্রুপে দেওয়া হয় পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে।
ফেইসবুকে প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ শোনার পর খুঁজতে খুঁজতে ‘Sk Bullet Raja’ নামে একটি অ্যাকাউন্টের প্রোফাইলে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক দেখেন, ৩০ অক্টোবর ঢাকা বোর্ডের লোগো প্রোফাইল ছবি ও ২০১৭ সালের জেএসসি পরীক্ষার ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের সাজেশনের ছবি প্রোফাইল কভারে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই দিনে দুপুর ১২ টা ৪৮ মিনিটে পোস্ট দেওয়া হয়, “J.S.C exam 2017 #Only_Dhaka_Board,, CQ+MCQ+Answer. প্রশ্ন দিব পরীক্ষার আগের দিন রাতে, যাদের ১০০% কমন প্রশ্ন লাগবে,,,,,,তারা #inbox কর,,,,,,,টাকা কমনের পর নিব,,,। আমাকে যারা চিনো তারা ভাল করেই জানো আমি কেমন আমি যা পারি না তা বলি না, বিঃদ্রঃ যাদের এরকম চিন্তা আছে যে,,প্রশ্ন নেওয়ার পর টাকা দিবেন না তারা দয়া করে মেসেজ দিবেন না,,”
৫ নভেম্বর দুপুর ২টা ৪১ মিনিটে এই প্রোফাইল থেকে পোস্ট দেওয়া হয় “যাদের ইংরেজি ২য় পত্র লাগবে আমাকে তারাতারি ইনবক্স মেসেজ কর only dhaka board’।”
এই পোস্টগুলো দেখে ৫ নভেম্বর বিকাল ৫টা ৩১ মিনিটে ‘Sk Bullet Raja’ অ্যাকাউন্টে প্রতিবেদক যোগাযোগ করে প্রশ্ন দিতে পারবেন কি না- জানতে চাইলে প্রতিবেদকের অ্যাকাউন্টটি ‘JSC English 1 Dhaka board 2017+’ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে অ্যাড করে নেওয়া হয়।
এই মেসেঞ্জার গ্রুপে মোট ৪৫ জন সদস্য দেখা যায়। ৫ নভেম্বর রোববার বিকাল ৫টা ১ মিনিটে ‘admin Sk Bullet Raja’ গ্রুপে লিখেছিলেন, “আজকে প্রশ্ন বোর্ড কপি পাবাই ইনশাআল্লাহ দোয়া কর।”
বিকাল ৫টা ৩১ মিনিটে ‘আরিফুল আরিফুল ইসলাম’ নামের অ্যাকাউন্টধারী একজন লেখেন, ‘সবাই যার যার ভাই বোনকে নিজের মত পড়তে বলেন। রাত 10 টার ভিতর প্রশ্ন দিব। উত্তর 1 ঘণ্টা পরে দিব। যদি চার দিকে অবস্থা পরিস্থিতি খারাপ দেখি। তাহলে 2 সেট দেয়ার চেষ্টা করব। তবে কোন সাজেশন না। আজকেই আমার জন্য কঠিন পরীক্ষা দিতে পারি কিনা। এ লাইনে যে যত প্রশ্ন দিবে বলে ভাষন দেয়, সব ভোকাস। কেউ পারে না। আর আমি ও যদি না পারি।তাহলে নিজেই স্বীকার করি তাদের চেয়ে আমি আরো বেশি চাপাবাজ। সুতরাং আমার জন্য লাস্ট ও ফ্রাস্ট অগ্নী পরীক্ষা।”
রাত ১০টা ৩৯ মিনিটে ‘আরিফুল আরিফুল ইসলাম’ অ্যাকাউন্ট থেকে হাতে লেখা চারটি ও ছাপানো একটি সাজেশনের ছবি দিয়ে লেখা হয়-“board copy ashar ag porjonto poro eta”
রাত ১১টা ৫ মিনিটে ছাপানো আরেকটি সাজেশন পত্রের ছবি দিয়ে ১১টা ৭ মিনিটে ‘আরিফুল আরিফুল ইসলাম’ লেখেন, “কথা দিলাম কাল সবার হাসিমুখ হবে, ইনশাল্লাহ। আজ কোন বাজে প্রশ্ন হইনি হবে না। যাস্ট আমি দিব। প্লীজ ধৈর্য ধরুন। আজ ক্লিয়ার পিক দিব। আর কথা দিলাম কাল সবার হাসিমুখ হবে।”
পরীক্ষার দিন অর্থাৎ সোমবার সকাল ৭টা ৪২ মিনিটে লেখা হয়, “সবাই শুনেন, যার সাথে কন্টাক করছিলাম, ওনি আমার সাথে প্রতারনা করছে। তাই আমি এক স্কুল টিচার সাথে কন্টাক করছি। সেন্ট্রারে নিয়া যাবার সময়। বিশেষ করে 8:45 থেকে 9:10 এ প্রশ্ন পাব। আমরা 4 জন শিক্ষক 5 মিনিটে উত্তর করে দিব। তার মানে 9:20 সব গ্রামার কমপ্লিট করে দিব। আর আজকের জন্য সকল স্টুডেন্ট 9:55 বা 10:00 টা হলে গেলে চলবে। কোন সমস্যা নাই।। এটা যাস্ট প্রশ্ন ফাস যাতে না হয় তার জন্য।”
এরপর সকাল ৯টা পাঁচ মিনিটে ‘আরিফুল আরিফুল ইসলাম’ অ্যাকাউন্টটি থেকে ইংরেজি ২য় পত্রের ‘Ka set’, ‘অয়োময়’ নামের এক সেট প্রশ্নপত্রের দুটি ছবি ও তার হাতে লেখা উত্তরের ১২ টি ছবি দেওয়া হয়। এই প্রশ্নপত্র এক ঘণ্টা পর সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হওয়া জেএসসি ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
এরপর সকাল ১১টা ৫ মিনিটে প্রশ্ন ফাঁসের ‘কৃতিত্বের’ ঘোষণাও আসে ‘SK Bullet Raja’ অ্যাকাউন্ট থেকে। যারা প্রশ্ন পেয়েছে তাদের কাছে ৪০০ টাকা করে চাওয়া হয়, দেওয়া হয় একটি রকেট ও একটি বিকাশ নম্বর।
এরপর সোমবার বিকালে মেসেঞ্জার গ্রুপ ‘JSC English 1 Dhaka board 2017+’ এর নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয় ‘jsc ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’। রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে ‘আরিফুল আরিফুল ইসলাম’ নামের প্রোফাইল থেকে গ্রুপে মেসেজ দেওয়া হয়, ‘তুমরা যারা পরিক্ষা দেও তারা সাথে কাওকে নিয়ে জাইবা জেন মোবাইল রাখতে পারে, মা বাবা ভাই বোন জে জা পার mcq Ta sokal 9 tai hobe tai sathe kawk niye jaiba, পড়া সেস হলে মোবাইল অভিবাভক দের কাছে রাইখা হলে ডোকবা। আর হে সবাই সকাল ৮ হতে ৯ তা পর্যন্ত নেটে থাকবা mcq dewa hobe answer soh’।
এরপর পরীক্ষার দিন মঙ্গলবার সকাল ৯টা ১১ মিনিটে ‘Sk Bullet Raja’ প্রোফাইল থেকে মেসেজ আসে, “ATTENTION PLZ, আজকে সেন্টারে সিকিউরিটি হার্ডের জন্য প্রশ্ন দিতে লেইট হচ্ছে। আপনারা দয়া করে ওয়েট করুন। MCQ+ANS পড়তে বেশি সময় লাগবেনা। ধৈর্য ধরে ওয়েট করুন। ধন্যবাদ।”
৯টা ২২ মিনিটে ‘আরিফুল আরিফুল ইসলাম’ কোনো একজনের সঙ্গে মেসেঞ্জারে তার কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট পাঠায়।
এর পরপরই সাড়ে ৯টায় বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের দুটি ছবি পাঠায় ‘আরিফুল আরিফুল ইসলাম’, সেই সঙ্গে লেখে, “fainal 100% board copy. poro sobai. mcq te answer kora ache.”
এই প্রশ্নগুলোও সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের প্রশ্নপত্র হুবহু মিলে যায়।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শহীদুল ইসলাম]