পরিবেশ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পেরেছেন বলেই ইউনেসকো সুন্দরবনের কাছে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তাদের অবস্থান থেকে ‘সরে এসেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী।
Published : 09 Jul 2017, 05:19 PM
ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফিরে রোববার বিদ্যুৎভবনে আয়োজিত বিদ্যুৎ বিভাগের ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক এই উপদেষ্টা বলেন, “পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের পথে রয়েছে সরকার। সে কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৃথিবীর অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা হবে। আন্তর্জাতিক সোসাইটিকে আমরা সেটা বুঝাতে সক্ষম হয়েছি।
“স্বল্প জমির বিপরীতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই অর্থনৈতিক অবাকাঠামো নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে। পৃথিবীর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করছি। এর ব্যাখ্যা আমরা তাদের দিয়েছি। সেই ভিত্তিতে তারা কনভিনসড হয়েছে।”
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ড. আহমেদ কায়কাউসসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন এ অনুষ্ঠানে।
পোল্যান্ডের ক্রাকাও শহরে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ওই অধিবেশনে সুন্দরবনের পাশে নির্মাণাধীন এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শুনানি হয়।
আর বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলোর তালিকায় যুক্ত করার যে প্রস্তাব শুনানিতে উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত তা বাদ দেওয়া হয়।
বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশবাদীদের একটি অংশের আশঙ্কা। এই প্রেক্ষাপটে ইউনেসকোও গতবছর উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে চিঠি দেয়; সেখানে রামপাল প্রকল্প সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
ওই অবস্থান থেকে ইউনেসকো সরে এসেছে মন্তব্য করে শুনানিতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়া তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বলেন, “ইউনেসকো আগে প্রকল্প বন্ধ করতে বলেছিল। সুন্দরবন এলাকায় রামপালসহ সব অবকাঠামো উন্নয়ন বন্ধ রাখতে বলেছিল। এখন রামপালের বিষয়ে সেই কথা তারা তুলে নিয়েছে।
“একদিকে বলেছিল রামপাল এলাকার স্ট্র্যাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট (এসইএ) করতে, অন্যদিকে প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে। তাদের সেই বক্তব্য অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। কারণ সরিয়েই যদি নিতে হয় তাহলে তো অ্যাসেসমেন্টের প্রয়োজন থাকে না। সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে যে প্রস্তাব এসেছিল সেটিও পাস হয়নি। এগুলোই হচ্ছে ইউনেসকোর অবস্থান থেকে সরে আসা।”
এখন বাংলাদেশকে রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব বুঝতে এসইএ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের পরিবেশ আইনে এমনটি নেই। তবুও আমরা এটা করব। আমরা এটা করতে চাচ্ছি, তাতে দীর্ঘমেয়াদী একটি ধারণা আমরা পাব। রামপাল থেকে আরও উত্তরে আমরা কীভাবে আরও প্রকল্প করব, সেটা এই অ্যাসেসমেন্ট থেকে জানা যাবে।”
হেরিটেজ কমিটির অধিবেশনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে ‘প্রফেশনাল লোক’ নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল বলে জানান তৌফিক-ই-এলাহী।
বিদ্যুৎসচিব আহমেদ কায়কাউস, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেসকোর স্থায়ী প্রতিনিধি এম শহীদুল ইসলাম, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউর রহমান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছুল আলম মণ্ডল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হুসাইন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুলতান আহমেদ ছিলেন ওই প্রতিনিধি দলে।
“তারা অত্যন্ত সুন্দরভাবে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তথ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, আমরা যুক্তিতে বিশ্বাসী। বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা-সমালোচনা হলে তাতে আমাদের আপত্তি নাই,” বলেন প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা।
রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র সেখানে নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের থাকলেও গতবছর ইউনেসকোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর সরকার দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। সেই সঙ্গে ওই এলাকায় অরিয়ন গ্রুপের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদন না করার কথাও ইউনেসকোকে জানানো হয়।
এ বিষয়ে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “রামপালে একটা করলে আমরা বুঝতে পারব সেখানে আরও প্রকল্প করা যাবে কিনা। আমরা আগেই বলেছি, আমরা পরিবেশবন্ধব উন্নয়নে বিশ্বাসী। প্রথম প্রকল্প থেকে আমরা ধারণা নেব, তারপর নতুন চিন্তা।”
ইউনেসকো রামপালে ‘সায় দিয়েছে’ বলে সরকার দাবি করলেও এ বিষয়ে হেরিটেজ কমিটির আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না আসায় তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন সংগঠন। সরকার ‘লবিংয়ের মাধ্যমে’ কোনো শব্দ ‘ম্যানিপুলেট’ করছে কি না সে সন্দেহও প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের বিশেষজ্ঞ, বিদেশে আমাদের কূটনীতিকরা এবং আমরা এ নিয়ে কাজ করেছি। এটা আমাদের দায়িত্ব। এর বাইরে লবিংয়ের কিছু নেই।”
বিদ্যুৎ সচিব বলেন, রামপাল থেকে ২০১৯ সালে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ওই বছর জুনে একটি ইউনিট চালু করার পর দ্বিতীয় ধাপে ডিসেম্বরে আরেকটি ইউনিট চালু করা যাবে বলে তারা আশা করছেন।