রামপালে সায় দিয়েছে ইউনেস্কো: সরকার

সুন্দরবনের কাছে রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্বেগের প্রশমন ঘটেছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2017, 01:20 PM
Updated : 31 July 2017, 03:45 AM

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি সুন্দরবনের প্রান্তসীমায় ওই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে তাদের আগের আপত্তি তুলে নিয়েছে।

সেই সঙ্গে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলোর তালিকায় যুক্ত করার পদক্ষেপ থেকেও ইউনেস্কো সরে এসেছে বলে মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য।

তবে বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা এখনও পাওয়া যায়নি।

বুধবার পোল্যান্ডে চলমান ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশনে সুন্দরবনের পাশে নির্মাণাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শুনানির পর ওই ঘোষণা আসে।

ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় কোন কোন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন থাকবে, কোনটি বাদ যাবে এবং কোন নিদর্শন ঝুঁকিতে রয়েছে - সেসব বিষয়ে ২১ সদস্যের এই হেরিটেজ কমিটিই সিদ্ধান্ত নেয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, দীর্ঘ আলোচনার পর হেরিটেজ কমিটি যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সুন্দরবনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়িয়ে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পিত স্থান রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে অনুমোদন করেছে।

পাশাপাশি হেরিটেজ কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী দেশের সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) চালাতে রাজি হয়েছে।

ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপালে যে স্থানে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, তা সুন্দরবনের প্রান্তসীমার চেয়ে ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং বনের বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে।

পরিবেশবাদীদের একটি অংশের আশঙ্কা, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের যাতে ক্ষতি না হয়, তার সব ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে।

পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের মধ্যে ইউনেস্কো গতবছর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের কাছে ওই বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে  সরকারকে চিঠি দেয়।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পশুর নদ পানি উত্তোলন ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের প্রতিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করে রামপাল প্রকল্প বাতিলের সুপারিশ করা হয় ওই চিঠিতে।

সরকার সেই চিঠির জবাবে ইউনেসকোকে জানায়, রামপালে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, ফলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না।

তবে রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার কথা জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে। সেই সঙ্গে ওই এলাকায় অরিয়ন গ্রুপের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদন না করার কথাও জানানো হয়। 

রামপাল নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ২০১৬ সালের মার্চে ইউনেস্কোর তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন।

পরে যে প্রতিবেদন তারা জমা দেন, তাতে রামপালকে সুন্দরবনের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রকল্পটি অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়।

তা না হলে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা বাতিল করে একে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে পোল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির অধিবেশনে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়।

এরপর মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তরে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের যুক্তিগুলো তুলে ধরেন এবং প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে ইউনেসকোর সমর্থন প্রত্যাশা করেন। 

২ জুলাই থেকে পোল্যান্ডে শুরু হওয়া হেরিটেজ কমিটির শুনানিতেও বাংলাদেশ সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী।

ওই শুনানিতে হেরিটেজ কমিটির উপস্থাপন করা প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসার ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। 

সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার অরিয়নের বিদ্যুৎ প্রকল্প ও রামপাল দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা বাতিল করার পাশাপাশি কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়নের (এসইএ) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউনেসকো তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইউনেসকো অনুরোধ করছে, সমীক্ষা শেষ হওয়ার আগে ওই এলাকায় রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বা বড় কোনো শিল্প বা অবকাঠামো যাতে নির্মাণ করা না হয় তা সরকারকে নিশ্চিত করতে এবং এসইএ প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পর্যালোচনার জন্য হেরিটেজ সেন্টারে পাঠাতে অনুরাধ করা হচ্ছে। 

সেখানে আরও বলা হয়,রামপালে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পানি ও বায়ু দূষণ বাড়বে। সেই সঙ্গে নৌচলাচল ও ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনও বাড়বে; প্রচুর মিঠা পানি তোলার প্রয়োজন হবে। এর বিরূপ প্রভাব কীভাবে সামাল দেওয়া হবে তা থাকতে হবে ওই ইআইএ প্রতিবেদনে।       

২০১৬ সালে ইউনেস্কোর রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের দেওয়া সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে ২০০৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা সংরক্ষণের হালনাগাদ তথ্যসথ একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয় হেরিটেজ সেন্টারের প্রস্তাবে। সুপারিশ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে না পারলে তখন সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয় প্রস্তাবে।

শুনানিতে তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা এবং ঝুঁকি প্রশমনে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। 

তুরস্ক ও ফিনল্যান্ডের সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার পর হেরিটেজ কমিটি সুন্দরবনের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানায়।

সেখানে বাংলাদেশকে ইউনেস্কোর রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের ২০১৬ সালে করা সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। আর সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবটি বাদ দেওয়া হয়।

শুনানির পর ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহিদুল ইসলাম টেলিফোনে সময় টেলিভিশনকে বলেন, “ওদের যে প্রাথমিক একটা অবস্থান ছিল (রামপাল) এটা সরিয়ে নিতে হবে, রিলোকেশন, ওইটা থেকে ওরা ফিরে এসেছে। ওটা আর এখন ওরা চাচ্ছে না। 

“ওরা যেটা বলছে যে এখানেই করা যাবে, মিটিগেশন মেজারস এইগুলো নিয়ে (রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র) এইখানেই করা যাবে।”

হেরিটেজ কমিটির এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রবিরোধীরাও। আন্দোলনকারীদের একটি সংগঠন সুন্দরবন বাঁচাও কমিটির সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ইউনেস্কো সায় দিলেও বাংলাদেশের পরিবেশের কথা ভেবে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

আন্দোলনকারী অন্য সংগঠন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতায় অনড় রয়েছে।